ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে


ড. এম এন আলম\ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশেও ওষুধের বাজার পুরোটাই ছিল বহুজাতিক কম্পানিগুলোর দখলে। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ওষুধশিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রাণালয়ের ঔষধ শাখাকে ‘ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তরে’ উন্নীত করেন, যা ঢাকার হাটখোলা রোডের ভাড়া করা টিনশেড দালানে থেকে কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীকালে মতিঝিল হয়ে ঔষধ প্রশাসনের প্রধান কার্যালয় এখন ঢাকার মহাখালীতে নিজস্ব ঔষধ ভবনে অবস্থিত।
দেশের গরিব জনসাধারণকে বহুজাতিক কম্পানির অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি এবং দেশীয় ওষুধশিল্পের বিকাশ ঘটানোর লক্ষ্যে ১৯৮২ সালের ২৮শে এপ্রিল ঔষধনীতি প্রণয়ন করতে আট সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়।
পিজি হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যাপক ডা. মো. নুরুল ইসলাম ওই কমিটির চেয়ারম্যান এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ডা. চৌধুরী বহুজাতিক কম্পানিগুলোর ব্যাবসায়িক কারসাজি নিয়ে সোচ্চার হন। তখন ভিটামিন, অ্যান্টাসিড, টনিক, গ্রাইপ ওয়াটারসহ নানা রকম অপ্রয়োজনীয় ওষুধে বাজার সয়লাব ছিল। কমিটি প্রভাবশালী কম্পানিগুলোর রক্তচুকে উপেক্ষা করে এক হাজার ৭৪২টি ওষুধকে অপ্রয়োজনীয়/অকার্যকর ঘোষণা করতে এবং সরকারিভাবে সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করে।
এর পরিপ্রেেিত ১৯৮২ সালের ১২ই জুন যুগান্তকারী ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশটি জারি করার পর ওষুধশিল্পের নবযাত্রা শুরু হয়। বহুজাতিক কম্পানিগুলোর নিষিদ্ধ, অপ্রয়োজনীয় এবং চড়া দামের ওষুধের পরিবর্তে দেশীয় কম্পানিগুলোর ওষুধকে দ্রæত রেজিস্ট্রেশন প্রদান, কাঁচামাল আমদানিসহ ন্যায্যমূল্যে বাজারজাত করার সুযোগ করে দেয় ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর। সস্তা শ্রমবাজার, দেশের কেমিস্ট, ফার্মাসিস্ট ও দক্ষ জনবলের সহযোগিতায় বিকশিত হতে থাকে ওষুধশিল্প। এক পর্যায়ে বিদেশে রপ্তানিও শুরু হয়।
বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যালস কম্পানিগুলোর ক্রমাগত উত্থানে কয়েক দশকের মধ্যে বহুজাতিক কম্পানিগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে দেশীয় কম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেক বিদেশি কম্পানি বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। বর্তমানে দেশে ৩১০টি অ্যালোপ্যাথিক কম্পানি চার হাজার ১৮০টি জেনেরিক নামে ৩৫ হাজার ২৯০টি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করে থাকে। বর্তমানে বিশ্বের ১৬০টি দেশে ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে।
১৯৮২ সালে ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি করার ফলে দেশের ওষুধশিল্পে বিপ্লবের সূচনা হয়। একটি আমদানিনির্ভর দেশ থেকে রপ্তানিমুখী গুরুত্বপূর্ণ খাতে ওষুধশিল্প রূপান্তরিত হয়, যার সুফল দেশের জনগণ ভোগ করছে। কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকার কিছুসংখ্যক সুবিধাবাদী ওষুধ উৎপাদনকারী কম্পানির স্বার্থে ঔষধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩-এ ৩০ ধারা সংযোজনের মাধ্যমে শুধু গেজেটে প্রকাশিত ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা সরকারের হাতে রেখে বাকি সব ওষুধের মূল্য কম্পানি নির্ধারণ করবে বলে বিধান করে। ফলে ওষুধের মূল্য রাতারাতি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
ওষুধ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করলেও বেশির ভাগ কম্পানি ওষুধের মূল কাঁচামাল ভারত, চীন বা অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি করে থাকে। ফলে ওষুধের মূল্য কয়েক গুণ বৃদ্ধিসহ মানসম্মত উৎপাদন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। ওষুধশিল্পকে দীর্ঘস্থায়ী শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সরকার ২০০৭ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ার বাউশিয়ায় ২০০ একর জমিতে ২৭টি কম্পানিকে ৪২টি অপঃরাব চযধৎসধপবঁঃরপধষং ওহমৎবফরবহঃং (অচও) প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও মাত্র চারটি কম্পানি কাঁচামাল উৎপাদন শুরু করে। বাকি কম্পানিগুলোকে দ্রæত কাঁচামাল (অচও) উৎপাদনে নিতে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কম্পানিগুলোর দক্ষ জনবল, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে নতুন নতুন ওষুধ উদ্ভাবনের সক্ষমতাসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে।
ওষুধের বাজারে বিদ্যমান বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিশেষজ্ঞ প্যানেল দেশি ও বিদেশি বাজার পর্যালোচনা করে গত এপ্রিলে স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে জেনেরিক নামে ওষুধের প্রেসক্রিপশন লেখা, ই-মেইল/অনলাইন মার্কেটিং এবং ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর বিপণনসহ মূল্য নির্ধারণের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়। দীর্ঘ প্রায় চার মাস অতিক্রান্ত হলেও কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো কার্যকরে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেই। সেসব এখনো লাল ফিতায় বন্দি রয়েছে।
আমাদের প্রত্যাশা, ১৯৮২ সালের মতোই সব ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারণ করা হবে। স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশনের প্রদত্ত সুপারিশগুলো সংযোজন করে আইনি কাঠামোতে রূপ দেয়ার জন্য নতুন অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। জনগণের দোরগোরায় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির মৌলিক অধিকারের প্রতি বর্তমান সরকার সম্মান দেখাবে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবে- এমনটিই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক উপপরিচালক ও আইন কর্মকর্তা, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর