শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ পাশ হলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে

‘ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন’ পাশ হলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে

মো. আশরাফ হোসেন॥ সমাজের আরও দশজনের মতো আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল, জরিপকালীন একজনের জমি অন্যজনকে দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া জরিপ বিভাগের নেশা ও পেশা। ফলে এ বিভাগে দায়িত্ব পালনের সূচনালগ্ন থেকে জরিপকালীন হাজার হাজার মামলা দায়ের ও ঘুস লেনদেনের কারণ খুঁজতে শুরু করি। পর্যালোচনায় দেখা গেল, ভূমি মালিকরাই বহুলাংশে এসব আপত্তি মামলার উদ্ভব ও ঘুস লেনদেনের ক্ষেত্র সৃজনের জন্য দায়ী।
ঢাকা জোনের ২০টি আদালতের আপত্তি মামলা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যক্তিমালিকানার ক্ষেত্রে আপত্তি মামলার হার প্রায় ২০ শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রেজিস্টার্ড আপস-বণ্টননামা না থাকা; ওয়ারিশ সনদে ভাই, বোন বা নিকটাত্মীয়দের নাম গোপন করা; প্রাপ্য অংশ পূর্বেই বিক্রি করার পর আরএস মালিক পিতা, মাতা বা দাদা হওয়ায় উত্তরাধিকার হিসাবে পুনরায় ফারায়েজ মোতাবেক দাবি করা; মালিকানার অতিরিক্ত জমি বিক্রয় করা; ভাই বা বোনদের অংশসহ পূর্বে বিক্রয় করায় জরিপকালীন ভাই বা বোন কর্তৃক ওই বিক্রীত জমি দাবি করা; পিতা বা মাতা কর্তৃক রেজিস্টার্ড দলিলমূলে বিক্রি করার পরও ইত্যবসরে সৃজিত আরএস রেকর্ড পিতা-মাতার নামে থাকার কারণে উত্তরাধিকারীগণ কর্তৃক ওই ভূমি পুনরায় বিক্রি করা; পিতা-মাতা ছেলেমেয়েদের হেবা করে দেয়ার পর ওই হেবা দলিল গোপন রেখে পুনরায় বিক্রি করা; পিতা-মাতা বিক্রি করার পর ক্রেতা কর্তৃক সঠিক সময়ে নামজারি না করায় বা
দখলে না থাকায় ওই জমি উত্তরাধিকারীগণ কর্তৃক আবার বিক্রি করা; মৌখিক আপস-বণ্টন থাকা সত্ত্বেও জমি অধিগ্রহণ বা জমির পাশে রাস্তা নির্মাণের কারণে জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মৌখিক আপস-বণ্টন অস্বীকার করে পুনরায় দাবি করা; দলিলের তফসিলে যে দাগ উল্লেখ করা হয়, বাস্তবে ভিন্ন দাগে দখল বুঝে দেয়া বা দলিলে উল্লেখিত দাগের জমি অন্যত্র বিক্রি করে দেয়া ইত্যাদি।
জমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সত্যিকার অর্থে দক্ষতা খুবই কম। ক্রয়সূত্রে মালিকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমির সীমানা চেনেন না। আবার দখলেও থাকেন না। দলিলে জমির তফশিল এক জায়গায়, কিন্তু দখল অন্য জায়গায় তা-ও বোঝেন না। যিনি আগে ক্রয় করেছেন, তিনি নামজারি করেননি। পক্ষান্তরে একই জমি যিনি পরে ক্রয় করেছেন, তিনি নামজারি করেছেন, দখলে আছেন, দ্বিতীয় বা তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রয়ও করেছেন। তারপরও জরিপের সময় প্রথম দলিলগ্রহীতা জমির রেকর্ড দাবি করেন।
একাধিক দাগে জমি ক্রয়পূর্বক দাগভিত্তিক নামজারি করেছেন। কিন্তু দখল করেন মাত্র ০১ দাগে, যার কোনো এওয়াজ দলিলও নেই। মালিকানার অতিরিক্ত জমি ক্রয়-বিক্রয় এবং নামজারি করেছেন। দলিলের জমির পরিমাণের সঙ্গে বাস্তবে দখলকৃত জমির পরিমাণের মিল না থাকা। ডোবা, নালা, পুকুর, বিল, নয়নজলি, নদী, খাল, হাওড়, বাঁওড় সব মোটা দাগে ‘জলাভূমি’ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় শ্রেণি পরিবর্তনজনিত কারণে আপত্তি মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মহানগরীগুলোর পার্শ্ববর্তী মৌজায় মাটি খনন বা বালু ভরাটের কারণে ব্ল­ক-প্ল­ট (৫/৬টি আরএস দাগের সমন্বয়ে একটি বিডিএস দাগ হওয়ায়) আপত্তি মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। অনেক সময় আবেদনকারী মামলা করেননি; কিন্তু ভূমি মালিককে ভোগান্তিতে ফেলার জন্য ভিন্ন ব্যক্তিও গোপনে আপত্তি মামলা করেন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরএস ম্যাপের সঙ্গে খতিয়ানের জমির পরিমাণ ঠিক না থাকায় আপত্তি মামলার উদ্ভব হয়। ভূমি মালিক মৌজা এলাকায় বসবাস করেন না। অন্য জেলায় বা বিদেশে থাকায় জরিপের সময় জমির প্রকৃত মালিকের অনুপস্থিতিজনিত কারণে পূর্ববর্তী আরএস রেকর্ডীয় মালিকের নামে সার্ভেয়াররা ভূমি রেকর্ড করতে বাধ্য হন। এর ফলে পরবর্তীকালে আপত্তি মামলা বৃদ্ধি পায়।
সম্প্রতি জরিপের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে সম্পৃক্ত ঢাকা জোনের ১০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সমন্বয়ে ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন এবং ২০টি আদালতের আপত্তি মামলা পর্যালোচনায় দেখা যায়: উত্তরাধিকার সূত্রে আপস-বণ্টন না থাকা, ওয়ারিশদের ফাঁকি দেওয়া, ওয়ারিশ হিসাবে মালিকানার বেশি বিক্রয় করা ইত্যাদি কারণে প্রায় ২০ শতাংশ; দলিলের তুলনায় বাস্তবে কম থাকায় প্রায় ১৫ শতাংশ; নামজারি না থাকা, দখল না থাকা, জমি চিহ্নিত না থাকা, শ্রেণি পরিবর্তনজনিত প্রায় ১৫ শতাংশ; অনুপস্থিতিজনিত প্রায় ১০ শতাংশ (মৌজাভেদে এর হার ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত); পূর্ববর্তী জরিপের নকশার সঙ্গে বর্তমান জরিপের তুলনামূলক নকশা (প্যান্টোগ্রাফ) সঠিক না হওয়ায় সাবেক দাগভিত্তিক আপত্তি দাখিল প্রায় ১৫ শতাংশ; সরকারি দপ্তর, সংস্থা ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত ১০ শতাংশ (মৌজাভেদে এর হার ৫ শতাংশও দেখা যায়); মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অদক্ষতার কারণে ভুল দাগ/খতিয়ানে মামলা দায়ের প্রায় ৩ শতাংশ; জমিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা না থাকলেও বিভিন্ন ব্যক্তির প্ররোচনায় মামলা দায়ের প্রায় ২ শতাংশ; অন্যান্য কারণে ১০ শতাংশ। তবে ৯৫ শতাংশের বেশি আপত্তি মামলা মালিকানা বা স্বত্ব সম্পর্কিত জটিলতার কারণে এবং ৫ শতাংশ মামলা সার্ভেয়ারদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে উদ্ভব হয়।
উল্লেখ্য, ভূমি জরিপের ১০টি স্তর আছে, যার মধ্যে ৬টিতেই প্রতিকার প্রার্থনা করার সুযোগ থাকে। খানাপুরি বুঝারত স্তরে অর্থাৎ মাঠ পর্চায় কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হলে ভূমি মালিকরা বুঝারত ডিসপিউট দিতে পারেন। সেখানে প্রতিকার না পেলে অ্যাটাস্টেশন স্তরে ডিসপিউট দেয়ার সুযোগ রয়েছে। সেখানেও ব্যর্থ হলে খসড়া প্রকাশনাকালীন আপত্তি মামলা এবং পরবর্তী পর্যায়ে আপিল মামলা দায়ের করতে পারেন। তদুপরি জরিপকালীন কোনো তঞ্চকতা পরিলক্ষিত হলে চূড়ান্ত প্রকাশনার পূর্বে প্রজাস্বত্ব বিধিমালা ১৯৫৫-এর বিধি ৪২(ক) এবং চূড়ান্ত প্রকাশনার পর দ্য সার্ভে অ্যান্ড সেটেলমেন্ট ম্যানুয়াল ১৯৩৫-এর বিধি ৫৩৩ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসারের নিকট আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। এরপরও যদি বলা হয়, আমার জমি অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে গিয়েছে অথচ আমি জানিই না, তাহলে বুঝতে হবে, প্রতিকার প্রার্থনা করার পদ্ধতি হয় আমার জানা নেই অথবা আমি প্রতিকারের জন্য যথেষ্ট সচেতন ছিলাম না।
জরিপের কোনো স্তরে কোনো অসাধু কর্মকর্তা কোনো অনৈতিক দাবি করলে বা সুষ্ঠু প্রতিকার প্রদান না করলে চুপচাপ বসে না থেকে সংশ্লিষ্ট উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসার বা জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার বা সর্বোপরি মহাপরিচালক, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের কাছে মালিকানা সংক্রান্ত সমুদয় কাগজপত্র সন্নিবেশপূর্বক লিখিতভাবে আবেদন করা সমীচীন। চলমান বিডিএস জরিপে একটা খতিয়ান সৃজনের সঙ্গে সঙ্গে ভূমি মালিক অটোম্যাটিক্যালি একটা এসএমএস ও ইমেইল পাবেন। এমনকি বুঝারত খতিয়ানটি ইমেইলে পিডিএফ আকারে প্রাপ্তির সুযোগ রয়েছে। জরিপকালীন কোনো স্তরে কোনো ধরনের পরিবর্তন হলে সংশ্লিষ্ট ভূমি মালিক অটোম্যাটিক্যালি সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে পুনরায় এসএমএস ও ইমেইল পাবেন। ফলে একজনের জমি অন্যজনের নামে রেকর্ড হওয়ার কার্যত কোনো সুযোগ নেই। আশার কথা হলো, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন ২০২৩ মহান সংসদে পাশ হওয়ার ফলে অদূর ভবিষ্যতে ভূমি জরিপ তথা ভূমি ব্যবস্থাপনায় যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। তবে আইন ও বিধিবিধান যাই হোক না কেন, ব্যক্তি সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। সুত্র: যুগান্তর
লেখক : জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসার, ঢাকা

Share This