হারিয়ে যাচ্ছে কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেতশিল্প
ষ্টাফ রিপোর্টার\ সময়ের আবর্তে এবং প্রযুক্তির বদৌলতে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ-বেত বিলুপ্ত হতে চলেছে। এ স্থান দখল করে নিচ্ছে প্লাস্টিক ও কাঠের তৈরি জিনিসপত্র। এর মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের কদর বেশি।
কুমিল্লার এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী নমশূদ্র পল্লী কুটির শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। বংশগত কারণে নমশূদ্ররা এ পেশা ধরে রেখেছেন। আয় রোজগার যেমনই হোক, কাজটা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। তবে চড়া সুদের ঋণ এবং ঠিকমতো ঋণ না পাওয়ায় সংকটের মুখে পড়েছেন কুটির শিল্পীরা। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ চান পল্লীর মানুষ।
কুমিল্লার গোমতী নদীর পাশে পালপাড়া ব্রিজ। এ ব্রিজ থেকে ৫০ গজ পূর্বে গোমতীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষা নমশূদ্র পল্লী। কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার আড়াইওরা গ্রামে অবস্থিত এ পল্লীতে পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসতি। বংশ পরম্পরায় বাঁশের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রি করে চলে এখানকার বাসিন্দাদের সংসার। তাদের এসব পণ্য বিক্রি হয় কুমিল্লার দাউদকান্দি, হোমনা, নগরীর চকবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর বাজারে। সরাসরি পল্লীতে এসেও ব্যাপারিরা পণ্য সংগ্রহ করেন।
এ পল্লীর অন্তত এক হাজার মানুষ সম্পৃক্ত আছেন এ পেশায়। এর মধ্যে ৬ শতাধিক নারী। প্রতিমাসে খাবার খরচ বাদে একজন কুটির শিল্পী যা আয় করেন, তা থেকে সন্তানদের লেখাপড়া, ঋণ পরিশোধ ও আনুষাঙ্গিক খরচ মেটান। মানভেদে ১২০ থেকে ২৫০ টাকা দরে কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ি অঞ্চল থেকে তল্লা, মুলি ও বাঁশ সংগ্রহ করেন কুটির শিল্পীরা। সেই বাঁশ প্রথমে পানিতে ভেজান, তার পর শুকান। শুকনো বাঁশ আবার ভেজানোর পর পুনরায় শুকিয়ে শুরু হয় বেত তোলা। এ বেত থেকেই বাঁশেরকুলা, খাঁচা, ওরা, ঝুঁড়ি ও ডালা তৈরি হয়। মাছ ধরার ফাঁদও তৈরি হয় বর্ষা ঋতুতে। গড়ে ১২০-১৫০ টাকা দামে বিক্রি হয় এসব পণ্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কাঁচামালের দাম ও পরিবহন খরচের কারণে এ শিল্পীরা সংকটে আছেন। এ পেশায় জড়িতরা বলেন, দিন দিন বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই কারিগররা। বর্তমানে স্বল্প দামে হাতের নাগালে প্লাস্টিক সামগ্রী পাওয়ায় কুটির শিল্পের চাহিদা আর তেমন নেই। তাছাড়াও দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে এ শিল্পের কাঁচামাল বাঁশ ও বেত। অনেকে ভালো পুঁজি খাটাতে না পারায় অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। অনেকেই বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন বিদেশে।
এ পল্লীর সুধন চন্দ্র দাস, কালী দাস ও নিতাই চন্দ্র দাস বলেন, ‘যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আর সংসার চালানো যাচ্ছে না। বাঁশ-বেত ও অন্য সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেলেও তৈরির পণ্যের দাম আগের তুলনায় বেশি বাড়েনি। তাই এখন আগের মতো লাভ হয় না। বাধ্য হয়ে এ পেশার পাশাপাশি অন্য কাজ করে সংসার চালাতে হচ্ছে।’
তারা বলেন, যেখানে দুই বেলা ভাত খাওয়ার টাকাই জোগাড় করতে কষ্ট হচ্ছে, সেখানে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দেব কেমনে? এ কারণে এ পল্লীর অনেক নারী এ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও পুরুষ কুটির শিল্পীর সংখ্যা দিন দিন কমছে।
তারা বলেন, এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি ঋণ সহায়তা প্রয়োজন। বিভিন্ন এনজিও থেকে সাপ্তাহিক কিস্তিতে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হলেও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে জমি না থাকায় ঋণ সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না বলেও তারা অভিযোগ করেন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কুমিল্লার উপমহাব্যবস্থাপক মো. মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘ঐতিহ্যবাহী এ পল্লী পরিদর্শন করে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের নানা সমস্যার কথা অবগত হয়েছি। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তাদের নিবন্ধনের মাধ্যমে ঋণ সহায়তা দিবে বিসিক। এছাড়াও তাদের গ্রæপ করে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হবে।’