রবিবার, ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পরিবার মানুষের আসল ঠিকানা

পরিবার মানুষের আসল ঠিকানা

Views

            ড. ইউসুফ খান\ মানুষের ভাবনাগুলো বড়ই অদ্ভুত। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম হয়। আর এ জন্যই মানুষ সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। দিনের ভাবনার সঙ্গে রাতের ভাবনা মেলে না। তাইতো মানুষ ভাবে এক, করে এক; আর হয় আরেক। সবকিছুই অনিশ্চিত, গন্তব্যহীন জীবন। যেখানে সময়ের সঙ্গে বদলে যায় মানুষ। একবার এক বিখ্যাত নর্তকী জর্জ বার্নার্ড শকে লিখলেন, একবার ভাবুনতো, আপনি আর আমি যদি একটি শিশুর জন্ম দিই ব্যাপারটা কি চমৎকারই না হবে! সে পাবে আমার রূপ আর আপনার মতো মেধা। উত্তরে বার্নার্ড শ লিখলেন, যদি আমার মতো রূপ আর আপনার মতো মেধা পায়, তাহলে কী হবে?

পৃথিবীর সবকিছুই যেন অনিশ্চিত। কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। একজনের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে আরেক জনের চিন্তা-চেতনা মিলে না। একজনের কষ্ট থেকে আরেক জনের কষ্ট ভিন্ন।

ইদানীং সবকিছুতেই কেমন যেন নির্লিপ্ত হয়ে গেছি। কোনো কিছুতেই আর আগের মতো টান অনুভব করি না। গতানুগতিক জীবনটাকে একঘেয়ে মনে হয়। কোথাও কোনো বৈচিত্র্য নেই। কোনো কারণ ছাড়াই যুক্তিহীন হতাশা আর অস্থিরতায় পেয়ে বসে মাঝে মাঝে। এটাও বুঝি যে হতাশা একটা মানসিক রোগ। যে কোনো প্রাণঘাতী রোগের মতোই ভয়াবহ। হতাশাকে জিইয়ে রাখলে হতাশা আরো বাড়ে। হতাশায় পেয়ে বসার আগেই ঝেড়ে ফেলতে হবে। মনকে শক্ত করতে হবে। নইলে ঝোড়ো হাওয়ায় হারিয়ে যাবে মনের খেয়া।

সেদিন এক বন্ধুকে দেখতে হাসপাতালের কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টারে গেলাম। সেখানে গিয়ে অনড়ভাবে কিছু সময় বসে থাকলাম। আপাদমস্তক অবশ হয়ে এলো। কানের মধ্যে মানুষের যন্ত্রণা আর গোঙানির শব্দ ভেসে আসছিল। কয়েকজন রোগীর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। প্রতিটি মানুষের চোখে-মুখে বেঁচে থাকার কী যে স্বপ্ন! সুস্থভাবে একটু নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য কত আপ্রাণ চেষ্টা! এগুলো সব অন্তর দিয়ে অনুভব করলাম। চারপাশে তাকিয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হলো। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে এসে দাঁড়াই। বুক ভরে শ্বাস নিই। আর মনে মনে ভাবি কত ভালো আছি, সুস্থ আছি। সুস্থ থাকা যে কতটা জরুরি তা হাসপাতালে না গেলে বোঝা যায় না। এ জন্যই বিজ্ঞজনেরা বলেন, মাঝে মধ্যে হাসপাতালে যাওয়া-আসা করুন, তাহলে সুস্থতার মর্মটা বুঝতে পারবেন।

এক জীবনে তো আর কম দেখা হলো না। কত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে দেখা হলো, সঙ্গে জ্ঞানী-গুণী সৃষ্টিশীল মেধাবী মানুষও দেখা হলো, জানা হলো। অনেকের প্রতি যেমন মনের মধ্যে ঘৃণা ও বিরক্তির জন্ম নিয়েছে, তেমনি অনেকের সম্পর্কে গভীরভাবে জেনে বিস্মিত হয়েছি। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়েছে, মুগ্ধ হয়েছি। এমনি একজন মানুষ ছিলেন অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্টিভ জবস। তিনি যখন হাসপাতালের মৃত্যুশয্যায়, তখন ওনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাণিজ্যিক দুনিয়ায় তিনি সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন। কর্মক্ষেত্রে যারা ছিলেন সবচেয়ে প্রিয় সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, সুহৃদ, অসুস্থ অবস্থায় তারা কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি। আর এলেও চোখের দেখা দেখে চলে গেছেন। শুধুই থেকে গেছে প্রিয় পরিবার।

জীবনভর তিনি সম্পদ আহরণের পেছনে ছুটেছেন। ব্যস্ততার কারণে পরিবারের মানুষগুলোর ঠিকমতো খোঁজ-খবরও নিতে পারেননি। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসে খাবারের সময়টুকু হতে পারত অপার আনন্দের। তা কি আর তিনি ফিরে পাবেন? হাসপাতালের মৃত্যুশয্যায় শুয়ে তিনি উপলব্ধি করেন, সম্পদ সর্বক্ষেত্রে শান্তি নিশ্চিত করে না। ভালোবাসা আর মায়া মমতাই হলো সবচেয়ে বড় জিনিস, যা একটা পরিবারের শান্তি নিশ্চিত করতে পারে। পরিবারই হলো মানুষের আসল ঠিকানা, যেখানে স্বার্থপরতার লেশমাত্র নেই। ব্যস্ততা তাকে অর্থকড়ি দিয়েছে ঠিক; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে সুখ আর ভালোবাসা। তাইতো কবি বলেছেন, সুখ একটি আপেকি জিনিস। অল্পতেই সুখী হওয়া যায়।

লেখক : গবেষক, লেখক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

Share This