শনিবার, ১৬ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দিনে-রাতে প্রচন্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন

দিনে-রাতে প্রচন্ড গরমে বিপর্যস্ত জনজীবন

৭২ Views

            শফিউল আলম\ বৈশাখ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এসেও সারাদিন গনগনে সূর্যের কড়া রোদের আগুন যেন ঝলসে দিচ্ছে চারদিকের জনবসতি, মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। খাল-বিল ফেটে চৌচির। রাতের বেলায়ও তীব্র গরমে স্বস্তি নেই কোথাও। সবখানে যেন উত্তপ্ত কড়াই। প্রচন্ড গরমের সঙ্গে দিনে-রাতে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ মানুষ। টানা এক মাস নজিরবিহীন উচ্চ খরতাপে দুঃসহ জনজীবন। গত সোমবার চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপদ চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা চুয়াডাঙ্গা জেলায় গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এছাড়া অতি তীব্র ও তীব্র তাপপ্রবাহে দেশের উল্লেখযোগ্য উচ্চ তাপমাত্রা ছিলÑ যশোরে ৪২.৮, রাজশাহীতে ৪২.৬, পাবনায় ৪২.৫, খুলনায় ৪১.৮, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরায় ৪১.৫, মোংলায় ৪১.৩, ফরিদপুরে ৪১.২, গোপালগঞ্জে ৪১, টাঙ্গাইলে ৪০.৮, বগুড়ায় ৪০.৬, নওগাঁয় ৪০.৫, দিনাজপুরে ৪০.১ ডিগ্রি সে.।

            আবহাওয়া বিভাগের তথ্যে ঢাকার তাপমাত্রা উঠে গেছে সর্বোচ্চ ৪০.৫ এবং সর্বনিম্ন ২৯.৫ ডিগ্রি সে.। তবে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, পৌনে ২ কোটি মানুষের ঘিঞ্জি ঠিকানা ‘ইট-পাথর লোহা-কংক্রিটের জঞ্জাল’ ‘উত্তপ্ত কড়াই’ রাজধানী ঢাকায় দিনের বেলায় সর্বোচ্চ প্রকৃত তাপানুভূতি রীয়্যাল ফীল স্থানভেদে ৪৪ থেকে ৪৮ ডিগ্রি সে. এমনকি এর চেয়েও ঊর্ধ্বে রেকর্ড হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন! দিনের সাথে রাতের ‘সর্বনিম্ন’ তাপমাত্রাও দেশের অনেক জায়গায় ২৮ থেকে ৩০ ডিগ্রির ঘরে উঠে গেছে। আজও উচ্চ তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার কথা পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে। দেশে পঞ্চম দফায় হিট এলার্ট জারি রয়েছে।

            দিনে-রাতে প্রচন্ড গরমে ধড়ফড় করছে মানুষ, প্রাণিকুল। দেশের কোথাও ছিঁটেফোঁটাও বৃষ্টিপাত হয়নি। বাতাসে আর্দ্রতা বা জলীয়বাষ্পের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশিই রয়েছে। এর ফলে প্রচন্ড গরমে-ঘামে জনজীবনে কষ্ট-দুর্ভোগ ও অসুস্থতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে নিস্তেজ হচ্ছে অনেকেই।

            অবিরাম উচ্চ তাপপ্রবাহ, খরার দহন, অনাবৃষ্টিতে ঘরে ঘরে জ¦র-সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, শ^াসকষ্টসহ নানাবিধ রোগব্যাধিতে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মানুষ। টানা তাপদাহে পুড়ছে আধাপাকা ইরি-বোরো ফসল, আম-লিচু-জাম, পেঁপে, আতা, জামরুলসহ মৌসুমী ফল-ফলাদির বাগান, শাক-সবজি ক্ষেত, গবাদি পশু-পাখি, প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য। পোলট্রি খাতে বিপর্যয় চলছে। খামারেই মারা যাচ্ছে প্রতিদিন অসংখ্য ব্রয়লার মুরগি ও বাচ্চা। ডিম উৎপাদন কমে গেছে।

            নদ-নদী-খাল, পুকুর, দীঘি, জলাশয়, কূয়াসহ পানির প্রধান উৎসগুলো ইতোমধ্যে শুকিয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে সর্বত্র হাহাকার পড়ে গেছে। দূষিত পানি পান করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে অনেকেই। টানা প্রচন্ড রোদের আগুনে দিনে এনে দিনে খাওয়া দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক, কৃষি-শ্রমিক, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আয়-রোজগারে তীব্র সঙ্কট চলছে। অনেকেরই কাজকর্ম জুটছে না।

            আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে এ বছরই এপ্রিল মাসে সবচেয়ে বেশিদিন যাবত তাপপ্রবাহ চলছে, যা গত ৭৬ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তাছাড়া কালবৈশাখী বা বজ্র-ঝড়-বৃষ্টিবিহীন এমন চৈত্র-বৈশাখ মাস (এপ্রিল) গত ৪৩ বছরের মধ্যে আর দেখা যায়নি। এর পেছনে জলবায়ুর নেতিবাচক ধারায় পরিবর্তন এবং বন-জঙ্গল সবুজ প্রকৃতিকে নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞমহল।

            আবহাওয়া বিভাগ (বিএমডি) এবং আন্তর্জাতিক আবহাওয়া-জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসে জানা গেছে, মে মাসের প্রথম দিকে অর্থাৎ চলতি সপ্তাহের শেষে বাংলাদেশে স্থানভেদে হালকা থেকে মাঝারি কিংবা ভারী বৃষ্টিপাত, বজ্রসহ বৃষ্টি অথবা শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টিপাত হলে ক্রমে তাপমাত্রা কমে আসবে।

            সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা আরো কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে। রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে গরমে-ঘামে অস্বস্তিভাব বিরাজ করছে। পূর্বাভাসে আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।

            চলমান দাবদাহে বেশী বিপাকে পড়েছে কৃষক, দিনমজুর ও হতদরিদ্র মানুষ। মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে প্রচন্ড রোদে তাদের কাজ করতে হচ্ছে। ভ্যান চালক আবুল কাশেম বলেন, ভ্যান চালানোর সময় গায়ের চামড়া পুড়ে যাওয়ার মত হয়। গরমে এত কষ্ট সহ্য হয়না। কিন্তু পেট তো মানেনা। সে কারণে কাজে বেরুতেই হয়। কৃষক জলিল বলেন, এত রোদ গরমে মাঠে কাজ করার জন্য বাড়ী থেকে বের হতে ইচ্ছা হয়না। কিন্তু কৃষি কাজের জন্য মাঠে যেতেই হয়। আল্লাহ যে এ গরম থেকে কবে রেহাই দেবে।

            রিক্সাচালক মিনারুল হক বলেন, বাড়ীর সদস্যদের খাবার জোগাড় করতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই গরমে রিক্সা নিয়ে বের হয়েছি। ইজিবাইক চালক মমিন বলেন, প্রচন্ড গরমে মানুষ বাড়ী থেকে বাইরে বের না হওয়ার কারণে ভাড়া হচ্ছে না।

            এদিকে তীব্র তাপদাহের কারণে দিনমজুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে তেমন কেউ বের হচ্ছে না। শিশু ও বৃদ্ধরা নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

Share This

COMMENTS