শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বন্যার্তদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসুন

            ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ\ বর্ষা আসে, সঙ্গে আসে বন্যা। বন্যা নিয়ে প্রায় প্রতিবছরই ভোগান্তির চিত্র চোখে পড়ে। বর্তমানে দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় সেখানকার জনজীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বন্যায় মানুষ ও পশুপাখি ভয়াবহ দুর্গতির আশঙ্কায় রয়েছে। জলে ও স্থলে মানুষের উপর যত বিপর্যয় আসে তা তাদের কৃতকর্মের ফল।                আজ সমাজে বেহায়াপনা, অন্যায়, পাপাচার বেড়ে যাওয়ায় আল্লাহ মহামারি, রোগব্যাধি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে সতর্ক করছেন। আমাদেরকে এসব দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে তওবাহ করতে হবে। সবর করে গুনাহমুক্ত জীবন গড়তে হবে। বন্যাদুর্গত মানুষদেরকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করা ঈমানী দায়িত্ব। এটা আল্লাহর আদেশ।

            এ অবস্থায় সব ভেদাভেদ ভুলে আমাদেরকে দুর্গত জনগণকে রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। আর বায়ু আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহরই হুকুমে তা প্রবাহিত হয়। পানি আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহরই হুকুমে তা বর্ষিত হয়। বায়ু ও পানি ছাড়া যেমন মানুষের জীবন অচল তেমনি এই পানি-বায়ুই হতে পারে তার জীবননাশেরও কারণ। আল্লাহর হুকুমের কাছে মানুষ কত অসহায়। তবু মানুষ গর্ব করে। অহঙ্কারে লিপ্ত হয়। এই অহঙ্কারেরই এক দিক হল, বিপদাপদেও সচেতন না হওয়া, আল্লাহমুখিতা অবলম্বন না করা। প্রকৃতি আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহরই হুকুমে তা পরিচালিত। কাজেই আল্লাহর দিকে রুজু করা এবং তাঁর কাছে মুক্তির উপায় অন্বেষণ করা মুমিনের কর্তব্য।

            আল্লাহর হুকুম দুই প্রকারের। প্রাকৃতিক হুকুম এবং করণীয়-বর্জনীয়ের হুকুম। জীবন ও জগতে আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকর, তাঁর ইচ্ছাকে রদ করার কেউ নেই। জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনে এই সত্য পুনঃপুনঃ প্রকাশিত। কাজেই তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা কর্তব্য। বিপদাপদ আল্লাহরই তরফ থেকে- এই উপলব্ধি মানুষের মনে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে। আর আল্লাহর ভয়ই পারে মানুষের কর্ম ও আচরণকে সংশোধন করতে। যে বান্দা ক্ষণস্থায়ী জীবনের নানা দৃষ্টান্ত থেকে আল্লাহর পরিচয় লাভ করে এবং তাঁর আনুগত্যের পথ অবলম্বন করে সে চিরস্থায়ী জীবনে মুক্তি ও সফলতা অর্জন করে।            পক্ষান্তরে যে গাফিল ও উদাসীন থাকে এবং অবাধ্যতা ও নাফরমানীর মধ্যে সময় কাটায় সে চিরস্থায়ী জীবনে ব্যর্থ ও বন্দী হয়। কাজেই মানুষের কর্তব্য, জীবন ও জগতে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো থেকে শিক্ষা ও উপলব্ধি অর্জন করে নিজ করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং আল্লাহর ফরমাবরদারীর দিকে প্রত্যাবর্তন করা।

            আল্লাহর হুকুমে মানুষ যখন বিপদাপদে আক্রান্ত হয় তখন তার অসহায়ত্ব প্রকাশিত হয়ে পড়ে, ওই সময় আল্লাহ মহানের দিকে প্রত্যাবর্তন তার জন্য সহজ হয়ে যায়। কাজেই এ সময় আল্লাহমুখী হওয়াই স্বাভাবিকতা এবং এটিই মুমিনের গুণ। আর এ অবস্থাতেও আল্লাহর দিকে রুজু না করা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ।

            আর ইসলাম মানবতার ধর্ম। এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো, বিপদ মুক্তির জন্য সাহায্য করা ইসলামের শিক্ষা। তাদের দুর্দিনে আর্থিক সহায়তা, খাবার-দাবার, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে আসা ঈমানের দাবি। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের মতো অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করাও ইবাদত। আল্লাহতায়ালা মুমিনদের একটি দেহের মতো বানিয়েছেন। দেহের কোনো অংশ আক্রান্ত হওয়া মানে পুরো দেহ আক্রান্ত হওয়া। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মুমিনদের উদাহরণ তাদের পারস্পরিক ভালোবাসা, দয়া ও সহানুভূতির দিক থেকে একটি মানবদেহের মতো; যখন তার একটি অঙ্গ আক্রান্ত হয়, তখন তার পুরো দেহ ডেকে আনে তাপ ও অনিদ্রা।’ (মুসলিম : হাদিস ৬৪৮০)।

            আর যাদের সামর্থ্য রয়েছে তাদের প্রতি অসহায়-দুর্গত মানুষদের সাহায্য করতে পবিত্র কুরআনে নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সে দিন আসার আগেই যে দিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকবে না।’ (সূরা বাকারা : আয়াত ২৫৪)।

            হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘দয়াশীলদের ওপর কররুাময় আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা দুনিয়াবাসীকে দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ : হাদিস ৪৯৪১)। তবে এ ব্যয়, দান ও দয়া হতে হবে নিঃস্বার্থভাবে, অভাবী ও বিপন্ন মানুষের কাছ থেকে কোনোরকম প্রতিদানের আশা ছাড়া, কেবল আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য। যেমন আল্লাহতায়ালা সেদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত এতিম ও বন্দীদের খাবার দান করে। শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাবার দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান বা কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সূরা দাহর : আয়াত ৮-৯)।

            আর মানুষের বিপদে এগিয়ে এসে তার জন্য খরচ করাকে মহান আল্লাহ বিনিয়োগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর তা তিনি বহুগুণ ফেরত দেয়ার ওয়াদা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর সালাত কায়েম করো, জাকাত প্রদান করো এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও। আর তোমরা নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক যা কিছু আগে পাঠাবে তোমরা তা আল্লাহর কাছে পাবে প্রতিদান হিসেবে উৎকৃষ্টতর ও মহত্তররূপে। (সূরা বাকারা : আয়াত ২৪৫)। এ আয়াতে আল্লাহকে ঋণ দেয়ার অর্থ হলো তার পথে খরচ করা। গরিব, অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করা। পরকালে এর বিনিময় দেয়া হবে সওয়াবরূপে। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘কিসে তোমাদের দোজখে নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে আমরা মুমিনদের দলভুক্ত ছিলাম না, আমরা অভাবগ্রস্তকে আহার্য দান করতাম না। (সূরা মুদ্দাসসির : আয়াত ৪২-৪৪)। আর মানবতার নবী হজরত মুহাম্মদ সা: সব সময় অসহায় ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। মদিনার আনসার সাহাবিরা মুহাজির সাহাবিদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়িন, তাবে তাবেয়িন আল্লাহর রাসূলের এ আদর্শ লালন ও পালন করেছেন। পরবর্তী সুলতানি আমলের রাজা-বাদশাহরাও অসহায় মানুষের জন্য বিভিন্ন সরাইখানা, আশ্রয়কেন্দ্র, দারুজ জিয়াফাহ, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। অতএব, রাসূলুল্লাহ সা:-এর শিক্ষা ধারণ করে বন্যাকবলিত মানুষের পাশে যার যার সামর্থ্যানুযায়ী এগিয়ে আসা আমাদের দায়িত্ব ও জাতীয় কর্তব্য। বন্যায় দুর্গত মানুষজনের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।

            পরিশেষে বলতে চাই, বন্যা সৃষ্টিকর্তার এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। হযরত নুহ আ. এর উম্মতদেরও আল্লাহ তায়ালা বন্যার প্লাবনে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। নুহ আ. এর কিশতির ঘটনা আজও ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। নাফরমানি, সুদ, যেনা-ব্যাভিচার বেড়ে গেলে আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে বান্দাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। সতর্ক করেন পাপ পঙ্কিলতার। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেও বন্যায় আক্রান্ত অসহায় মানুষদের সেবায় এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দিয়েছে ইসলাম। বিপদ আপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের চিরকালীন শিক্ষা। আর্ত মানবতার সেবায় মুসলিম শাসকরা রাতের আঁধারে ঘুরে ঘুরে অনাহারীদের মুখে খাবার জুটিয়েছেন। ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন মুসলিম শাসকরা।

            রাসুল সা. বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তাঁর বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (বুখারি মুসলিম।) তিনি আরও বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া করো। আকাশের মালিক আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (মুসতাদরাক)। বন্যাদুর্গতের পাশে দাঁড়াবার এক বড় উপায় হচ্ছে, বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এই বিষয়েও সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগেরও প্রয়োজন আছে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে এই উদ্যোগ নিতে পারেন। দেশে এমন অনেক বিত্তবান ব্যক্তি আছেন, যারা ইচ্ছে করলেই শত শত মানুষের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারেন। কাজেই সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসলে লক্ষ লক্ষ দুর্গত মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হতে পারে। আল্লাহ তাআলা সকলকে নেক কাজের তাওফীক দান করুন- আমীন।

Share This

COMMENTS