শুক্রবার, ১৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

লোপাট করা গণমানুষের সম্পত্তি উপর নির্মিত  কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেটের ভাড়া  এখন গণপাঠাগারের নামে জমা দিতে হবে

লোপাট করা গণমানুষের সম্পত্তি উপর নির্মিত কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেটের ভাড়া এখন গণপাঠাগারের নামে জমা দিতে হবে

২৩ Views

স্টাফ রিপোর্টার।। প্রায় দেড়শ’ বছর পূর্বে কুমিল্লার গণমানুষের সম্পত্তি ‘বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তনের’ সম্পত্তির উপর নির্মিত কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেটের দোকানদারদের ভাড়া এখন থেকে গণপাঠাগারের একাউন্টে জমা দিতে হবে। সেই সাথে করতে হবে নতুন চুক্তি। দিতে হবে গত ৩ মাসের বকেয়া ভাড়াও। এর আগে এই ভাড়া নিতেন ভারতের আগরতলায় পলাতক কুমিল্লার দানবখ্যাত সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। গণমানুষের সম্পত্তি নিজের তল্পিবাহক কমিটির মাধ্যমে কথিত ‘লিজ’ নিয়ে বিল্ডিং নির্মাণ করে সে বিল্ডিংয়ের দোকান বিক্রি করে দেন সাবেক এমপি বাহার। সেখানে গড়ে তোলেন নিজের মেঝ মেয়ে আয়মান বাহার সোনালীর নামে হোটেল। গণমানুষের এই সম্পত্তি দখলে রেখে বছরের পর বছর লোপাট চালিয়েছেন এই বাহার। পুরো বিল্ডিংয়ের ১৫০ দোকান ও সোনালী হোটেল বাবদ প্রতি মাসে নামে মাত্র ১০ হাজার টাকা গণপাঠাগারকে ভাড়া দিতেন সাবেক এমপি বাহার। অথচ প্রতি মাসে তিনি আদায় করতেন ২৫/৩০ লাখ টাকা। আর টাউন হল ও গণপাঠাগার তাদের বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারী বেতন দিতে পারতেন না!

এ দিকে, কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো: আমিরুল কায়ছারের প্রচেষ্টায় বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন যা কুমিল্লা টাউন হল নামে সমধিক পরিচিত তার সংস্কারের তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে কুমিল্লা জেলা পরিষদ। তাছাড়া তিনি কুমিল্লা টাউন হল ভবনের ঐতিহ্য রক্ষায় ভবনটির পুরনো রূপ ফিরিয়ে আনতে স্থাপত্য শিল্পীর মাধ্যমে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। খুব শীঘ্রই সে পরিকল্পনা গণমানুষের সামনে উপস্থাপন করা হবে।

জানা গেছে, ১৮৮৫ সালের ৬ই মে বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন প্রতিষ্ঠিত করা হয়।  কুমিল্লার মানুষের কাছে যা কুমিল্লা টাউন হল নামে পরিচিত। ১৮৮৫ সালে তৎকালীন জেলা প্রশাসক এফ এইচ স্ক্রাইন ত্রিপুরার মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের কাছে পাঠাগার স্থাপনের জন্য জমি প্রদানের অনুরোধ জানালে মহারাজ কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়ে ১০ বিঘা জমি এবং একটি ভবন নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করে দেন।

জানা গেছে, কুমিল্লার গণমানুষের প্রবল আপত্তি বাধা ও মামলা উপেক্ষা করে ১৯৮৯ সালে কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেট নির্মাণ করা হয়। প্রথমে এর নাম ছিল হকার্স মার্কেট। মূলত: কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বসা কাপড়ের হকারদের পুনর্বাসনের নাম করে এই চারতলা মার্কেটটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৯০ সাল থেকে এখানে দোকানীরা ব্যবসা শুরু করেন। তাদেরকে চুক্তিপত্র দেওয়া হয় ১৯৯২ সালে। এরশাদ সরকারের শেষ সময়ে এই মার্কেট নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতার পক্ষে কুমিল্লা জেলা জজ আদালতে মামলা করা হয়। সে মামলা গড়ায় হাইকোর্ট পর্যন্ত। মামলা লড়েন তৎকালীন আইনজীবী ও পরে প্রধান বিচারপতি আবদুল ওহাব মিঞা। মহামান্য হাইকোর্ট স্থগিতাদেশও প্রদান করে কিন্তু তারপরেও বিল্ডিংটি নির্মাণ করা হয় নানা কৌশলে।
বিল্ডিংটি নির্মাণ প্রসঙ্গে কুমিল্লা টাউন হলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক দুলাল জানান, এটি তার আমলে লিজ দেওয়া হয়। যেহেতু কুমিল্লা টাউন হলের ফা- নাই, টাউন হল নিজে বিল্ডিং নির্মাণ করতে পারবে না। সেজন্য ঠিকাদার নিজের টাকায় বিল্ডিং নির্মাণ করবেন এবং ১০ বছর তা ভাড়া দিয়ে অর্থ তুলে নিবেন এবং ভাড়া থেকে কিছু অংশ টাউন হলকে প্রদান করবেন। ১০ বছর পর এ চুক্তি শেষ হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী ২০০২ সালে চুক্তি শেষ হওয়ার কথা।

জহিরুল হক দুলাল জানান, এরপর কিভাবে এতো বছর বাহারের কাছে আছে তা তার জানা নেই।জানা গেছে, ৪ তলা এই টাউন হল সুপার মার্কেটের নীচতলায় ১শ’ টি দোকান রয়েছে। ২য় তলায় রয়েছে ৪২টি দোকান। তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় সাবেক এমপি বাহারের মেয়ে সোনালীর নামে আবাসিক হোটেল। নীচ তলায় প্রতিটি দোকান থেকে ১ হাজার টাকা করে ভাড়া দেওয়া হয় বলে জানান কুমিল্লা শহর হকার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহামুদ কাজল। সে হিসেবে মাসে ১ লাখ টাকা ভাড়া তোলা হয়। সাবেক এমপি বাহারের প্রতিষ্ঠান মেসার্স কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ারের রশিদে এ ভাড়ার টাকা তোলা হয়। ২ তলায় প্রতি শার্টার দোকান ১৬ শ’ টাকা এবং দুই শার্টারে ৩২ শ’ টাকা মহারাজার জন্য ভাড়া তোলা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই শার্টারের এক দোকান মালিক জানান, তিনি প্রতিমাসে ৮০ হাজার টাকা ভাড়া দেন। এ ছাড়া ৩২শ’ টাকা দিতে হয় মহারাজার ভাড়া। গত তিন মাস কিভাবে ভাড়া দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, দোকান মালিক ভারতে পলাতক। হুন্ডির মাধ্যমে তার কাছে টাকা পৌঁছে যায়।

২য় তলার ৪২টি দোকান থেকে শুধুমাত্র মহারাজার নামে ভাড়া উঠে ১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। দোকান মালিকের ভাড়া হিসেব করলে চোখ কপালে উঠতে পারে। কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেটের ৩য় ও ৪র্থ তলায় সোনালী হোটেলে রয়েছে ছোট বড় ২৮টি রুম। প্রতি দিন এসব রুমের ভাড়া ১ হাজার থেকে ২৫ শ’ টাকা। সব দিনই রুম ভাড়া থাকে, খালি থাকে না। গড়ে প্রতিদিন হোটেল থেকে ভাড়া উঠে ৫০ হাজার টাকার বেশি। মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকা।

মার্কেটটির হোটেল ও নীচতলা, ২য় তলার ভাড়া উঠে সবমিলিয়ে মাসে প্রায় ১৭/১৮ লাখ টাকা। গত ত্রিশ বছর কুমিল্লা টাউন হলকে প্রতি মাসে মাত্র ১০ হাজার টাকা ভাড়া প্রদান করেন সাবেক এমপি বাহার। অথচ অর্থের অভাবে টাউন হলটির পাঠাগারের চেয়ার কেনা যায় না। বিদ্যুৎ বিল ও কর্মচারী বেতনও দেওয়া যায় না। এজন্য টাউন হলের ভিতরে চটপটি ও  ফুসকা এবং বাইরে কাপড়ের হকার বসানো হয়। এ আগে টাউন হল মাঠে অনেকটা স্থায়ীভাবে বসানো হয় ২০টির বেশি চায়ের দোকান। এগুলো থেকে কমিটির লোকজন নিতেন মোটা অঙ্কের ভাড়া। তাছাড়া কুমিল্লা টাউন হলের পাশের দিঘিতে মাছ চাষ করে তার আয় নিতেন কমিটির লোকজন। গেলো কয়েক বছর সেটি ভরাট করে দখলেও চেষ্টাও করে কমিটির দু’এক সদস্য। এসব দেখলেও কুমিল্লার মানুষ ছিলেন অসহায়। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।

এছাড়া আরো জানা গেছে যে, কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেটের দোকানদারদের ৭ জনের একটি প্রতিনিধি দল কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো: আমিরুল কায়ছারের সাথে সাক্ষাত করেন। মঙ্গলবার জেলা প্রশাসকের দপ্তরে তারা এ সাক্ষাত করেন। এ সময় তাদের নামে দোকান বরাদ্দ বা ভাড়া নেওয়ার কাগজপত্র চাওয়া হলে তারা কোন কাগজপত্র দেখাতে বা জমা দিতে পারেন নি। কুমিল্লার জেলা প্রশাসক এ সময় দোকানদারদের কাছে জানতে চান জায়গার মালিক কে ? তখন দোকানীরা জানান, বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন এ জায়গা ও বিল্ডিংয়ের মালিক।

এ সময় বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের একাউন্টে প্রতিমাসে ভাড়ার টাকা জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আগামী ২০শে নভেম্বরের মধ্যে গত ৩ মাসের বকেয়া একাউন্টে জমা দিতে বলা হয়। সেই সাথে নতুন করে গণপাঠাগারের সাথে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
কুমিল্লা টাউন হল সুপার মার্কেটের নীচতলায় অবস্থিত দোকানদারদের সংগঠন কুমিল্লা শহর হকার্স সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাসান মাহমুদ কাজল জানান, কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মহোদয়ের সাথে আমাদের আন্তরিকতাপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। তিনি বলেছেন, গণপাঠাগারের একাউন্টে ভাড়া জমা দিতে, আমরা তাই করবো। আমাদের বৈধতা ছিল না। জায়গার মালিক গণপাঠাগার। আমরা তাদেরকেই ভাড়া দিবো, আমরা নিজেরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদেরকে বৈধতাও দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসকের সিদ্ধান্ত আমরা খুশি। আমরা বৈধতা চাই, আমরা বঞ্চিত ও নিগৃহীত।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো: আমিরুল কায়ছার দৈনিক কুমিল্লার কাগজকে জানান, আমরা দোকানদারদের কাছে জানতে চেয়েছি মার্কেটের মালিক কে ? তারা বলেছেন- বীরচন্দ্র গণপাঠাগার। আমরা বলেছি তাহলে ভাড়া কে পাবেন ? তারা বলেছেন গণপাঠাগার পাবে। তাদেরকে গণপাঠাগারের একাউন্টে ভাড়ার টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়ছার আরো জানান, বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের উন্নয়নে জেলা পরিষদ থেকে তিন কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। টাউন হল ভবনটির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে স্থাপত্য পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। পুনসংস্কার করে ৫০ বছর আগে দরজা জানালা যেভাবে ছিলো সেভাবে তৈরি করা হবে। এসব করার আগে এটির থ্রিডি ডিজাইন গণমানুষের সামনে উপস্থাপন করা হবে।

জানা গেছে, কুমিল্লার গণমানুষের সম্পত্তি দশকের পর দশক লুট করলেও কুমিল্লার মানুষের চেয়ে থাকা ছাড়া আর করার কিছুই ছিল না। এর মধ্যে সাবেক এমপি বাহার ক্ষমতার দাপটে বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের সম্পত্তিতে আধুনিক কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার এই উদ্যোগকে কুমিল্লার মানুষ ভালো চোখে দেখেননি। ফলে ঐ উদ্যোগের বিরোধীতা হয় জাতীয় পর্যায়েও। কুমিল্লার মানুষ মনে করেন কমপ্লেক্স নির্মাণের নামে টাউন হল সুপার মার্কেটের মতো পুরো টাউন হলটিও তিনি তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে পারেন। জাতীয় পর্যায়ের শিল্পী-সাহিত্যিক ও বিশিষ্টজনরা তখন জীবন থাকতে বীরচন্দ্র গণপাঠাগারের ঐতিহ্য নষ্ট করতে না দেওয়ার শপথ নেন। সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সাথে দেখা করে ঐ কমপ্লেক্স নির্মাণে উদ্যোগের বিরোধীতা করেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তখন সে উদ্যোগ স্থগিত করে দেন। ভারতীয় দূতাবাস থেকেও নীরবে সে উদ্যোগের বিরোধীতা করা হয়।

কুমিল্লার বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও দৈনিক কুমিল্লার কাগজের সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয় জানান, আমাদের বক্তব্য ছিলো ঐতিহ্য রক্ষা করে কুমিল্লা টাউন হলের আধুনিক ভবন নির্মাণ করা। কিন্তু সাবেক এমপি বাহার সেটি না করে তার মনমতো ডিজাইন করেন। মূলত এর মাধ্যমে টাউন হলের সম্পত্তিতে তিনি একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিলেন। সে কারনে আন্তর্জাতিক থিওসিফিক্যাল সোসাইটির জায়গাও তিনি কৌশলে দখল করে রেখেছিলেন। সে সময় দুর্দ- প্রতাপশালী বাহারের বিরুদ্ধে আমরা কয়েকজন নির্ভিকভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের প্রচেষ্টা ছিল কুমিল্লার গণমানুষের সম্পত্তি তদুপোরি কুমিল্লা টাউন হলের সম্পত্তি রক্ষা করা, আমরা সফলতাও পেয়েছি। অথচ, সাবেক এমপি বাহার গণশুনানী ও গণজমায়েত করে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টার পাশাপাশি হুমকি ধমকিও দিয়েছিলেন আমাদেরকে। সৌজন্যে: কুমিল্লার কাগজ

Share This