বুধবার, ১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ডাকাতিয়া: কচুরিপানা আর দখল-দূষণে এখন মৃতপ্রায়

ডাকাতিয়া: কচুরিপানা আর দখল-দূষণে এখন মৃতপ্রায়

১৯১ Views

            ষ্টাফ রিপোর্টার॥ বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত একসময়ের খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদী কচুরিপানা আর দখল-দূষণে এখন মৃতপ্রায়। সময়ের বিবর্তনে নদীটির অনেকাংশ এখন অবৈধ দখলদারদের দখলে। প্রতিনিয়ত পড়ছে দূষণের কবলে। ভরা মৌসুমে ঢেকে থাকে কচুরিপানায়। নাব্য হারিয়ে পরিণত হয়েছে মরা খালে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রায় নদীটি একসময় যেমন এলাকাবাসীর অংশীদার ছিল তেমনি শোভাবর্ধন করেছিল এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও।

            এই নদীর নাম ডাকাতিয়া। তবে কেন এ নাম, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহলের যেন শেষ নেই। ইতিহাস স্যা দেয়, একটা সময় ডাকাতিয়া নদী ছিলো তীব্র খরস্রোতা। মেঘনার এ উপনদীটি মেঘনার মতোই উত্তাল ছিল। ফলে এ নদীর করাল গ্রাসে দু’পাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাত। উত্তাল এ নদী পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের সলিল সমাধি হয়েছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী ছিল বলে এর নামকরণ হয়েছে ডাকাতিয়া নদী। কথিত আছে একটা সময় এই নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লায় প্রবেশ করতো। এই নদীতে তাদের মাধ্যমেই ডাকাতি হতো। ডাকাতির উপদ্রবের কারণেই নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে। তাই ডাকাতিয়া নামে খ্যাতি পেয়েছে নদীটি।

    সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডাকাতিয়া নদী বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি মেঘনার উপনদী হিসেবেও পরিচিত। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আসা কাঁকড়ি নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের কাশীপুর এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম, সদর দণি, লালমাই, লাকসাম, মনোহরগঞ্জ ও চাঁদপুরের শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ ফরিদগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ২০৭ কিলোমিটার। ডাকাতিয়া নদীটির গড়ে প্রস্থ হলো ৬৭ মিটার (প্রায় ২২০ ফুট) এবং নদীটির প্রকৃতি হলো সর্পিলাকার।                সরেজমিন দেখা যায়, লাকসাম দৌলতগঞ্জ বাজার, রাজঘাট ও গাজীমুড়া পর্যন্ত ডাকাতিয়া নদীর দু’পাড়ে দখল করে গড়ে তুলেছে শত শত দোকান ও কলকারখানা। আবার কোথাও কোথাও নদী ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। বর্তমানে নদীটির কোথাও ২২০ ফুটপ্রস্থ খুঁজে পাওয়া যায় না। জৌলুশ হারিয়ে ২২০ ফুটের নদীটি কোথাও ৩০ আবার কোথাও ৪০ ফুটের মরা খালে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে কুমিল্লা ইপিজেড ও কুমিল্লা শহরের যাবতীয় বর্জ্য সিটি করর্পোরেশনের ড্রেন দিয়ে রোহিতা খাল হয়ে সোনাইছড়ি খাল, নতুন ডাকাতিয়া নদী, পুরাতন ডাকাতিয়া, গুইঙ্গাজুড়ি নদীতে শাখা খালের মাধ্যমে এই বর্জ্য গিয়ে নদীতে পড়ে। যার কারণে দূষিত হচ্ছে নদীর পানিও। সোনাইছড়ি পানি অথরাইড ফেডারেশনের সভাপতি পরিচয় দানকারী শহীদ আহম্মেদ বাবুল বলেন, কুমিল্লা ইপিজেডের সমস্ত ময়লা আবর্জনা প্রথমে রোহিতা খাল হয়ে সোনাইছড়ি খাল দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং পরে তা ডাকাতিয়া, গুইঙ্গাজুড়ি গিয়ে পরে। যার কারণে পানি অতিরিক্ত মাত্রায় দূষিত হচ্ছে। কুমিল্লা ইপিজেডে ইটিপি থাকলেও যথাযথ ব্যবহার না হওয়াতে ময়লা আর্বজনার পরিমান বেশি হচ্ছে।

            ডাকাতিয়া পাড়ের বাসিন্দা মো. খায়রুজ্জামান জানান, একসময় ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহন হয়েছে নৌকায়। পরিবহন খরচও ছিল কম। এখন সড়কপথে পরিবহন খরচ অনেক বেশি। ডাকাতিয়া নদী নাব্যতা হরিয়েছে, ইঞ্জিনচালিত নৌকা আসতেও সমস্যা হয়। নদী খননের উদ্যোগ নেয়া দরকার। বালু ব্যবসায়ী রবিউল হাসান বলেন, নদীর সীমানা নির্ধারণ করে একটি সার্ভের মাধ্যমে নিশানা দেয়া দরকার। তাহলে বালু ব্যবসায়ীদের আর বেকায়দায় পড়তে হয় না।

            লাকসাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কায়সার হামিদ বলেন, ডাকাতি নদীর হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার জন্য নদীর সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। অবৈধ দখল উচ্ছেদ, নদী খনন ও ওয়াকওয়ে, লাইটিংসহ দৃষ্টিনন্দন করার জন্য একটি তালিকা মন্ত্রণালয়ে জমা আছে।

            এ বিষয়ে কুমিল্লা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজিব বলেন, মূলত এটা ইপিজেড-এর বর্জ্য না, ইপিজেডের ভেতরে যে ইটিপি আছে ওরা ঐটা নিষ্কাশন করে ফেলে। এখানে কুমিল্লা সিটির যে বর্জ্য আমাদের বাথরুমের বর্জ্য, রান্নার বর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, তরল বর্জ্য, অন্যান্য সব বর্জ্য ডাকাতিয়া নদী হয়ে যায়। মূলত এগুলো কুমিল্লা শহরের বর্জ্য। পাশাপাশি বিভিন্ন কলকারখানার দূষিত বর্জ্য ও আবর্জনা ফেলে বিষাক্ত করে তুলেছে নদীটিকে। নদীর দু’পাড় দখল করে দোকান, মার্কেট ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করে রেখেছেন। এ যেন নদী দখলের উৎসব। লাকসাম বাজার এলাকার কয়েক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে যার সুবিধা মতো নদীর পাড় দখল করে দোকান ঘর নির্মাণ করেছেন। কেউ কেউ নিজে করেছেন দোকান আবার কেউ ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। আর এটা একদিনে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে ডাকাতিয়া।

            পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, দখল উচ্ছেদের জন্য বাজেট লাগে। বাজেট হলে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করব।

            মূলতঃ ডাকাতিয়া নদী একসময় সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গেই জড়িত ছিলো। অথচ আগের মতো ফসল উৎপাদনের জন্য ডাকাতিয়া নদীর পানি না পাওয়ায় কৃষিকাজে নিদারুণ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই অবিলম্বে দখল-দূষণের কবল থেকে নদীটিকে রা করে জরুরিভিত্তিতে খনন করা প্রয়োজন মনে করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীরা।

            বিশেষ করে ডাকাতিয়া নদী দখল-দূষণ আর ভরাটের পেছনে কারা জড়িত, তা কর্তৃপক্ষের অজানা থাকার কথা নয়! এমনিতেই নদী দখল-দূষণ আর ভরাটের প্রভাব পড়েছে দেশ জুড়ে। সময়ের ব্যবধানে অনেক নদী ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে, আবার অনেক নদী হারিয়ে যাওয়ার পথে। নদ-নদী তথা প্রাকৃতিক সম্পদের তি অপূরণীয়। তাই ডাকাতিয়া নদীসহ দেশের অন্যান্য নদ-নদী রায় দ্রুত প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ করা এখন এলাকাবাসীর প্রাণের দাবীতে পরিণত হয়েছে।

Share This