বৃহস্পতিবার, ১০ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কুমিল্লায় ১৪ মাসে ১০ জনকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা

কুমিল্লায় ১৪ মাসে ১০ জনকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা
৪৩১ Views

            ষ্টাফ রিপোর্টার\ কুমিল্লায় গত ১৪ মাসে ১০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে কোন মামলায় পুলিশ এখনো অভিযোগপত্র দিতে পারেনি।

মুরাদনগর উপজেলার পালাসুতা গ্রামে গত ১২ই জানুয়ারি ডাকাত সন্দেহে মাইকে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ৩ জনকে গণপিটুনি দেয়া হয়। ঘটনাস্থলেই দু’জনের মৃত্যু হয়। পৃথক দু’টি মামলা হয়। পুলিশ মামলার তদন্ত করছে। তবে সেদিন ডাকাতির চেষ্টা বা ঘটনা ঘটেছিল কি না তার প্রমাণ ৮ মাসেও পায়নি পুলিশ।

মুরাদনগরের পালাসুতা গ্রামের ঘটনায় রাত সাড়ে ১১টার দিকে স্থানীয় নায়েব আলী ওরফে নাবু মিয়ার ঘর থেকে তাঁর জামাতা নুরু মিয়াসহ ৩ জনকে ধরে নিয়ে পিটুনি দেয় জনতা। এতে নুরুসহ দু’জনের মৃত্যু ও একজন আহত হন। নিহত দু’জনের পরিবার ও আহত যুবকের ভাষ্য, তাঁরা ওই দিন রাতে হত্যার শিকার একজনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁরা যখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন, তখনই ঘর থেকে তুলে নিয়ে তাঁদের গণপিটুনি দেয়া হয়। নিহত নুরুর (২৮) বাড়ি উপজেলার কাজিয়াতল গ্রামে।              আর নিহত ইসমাইল হোসেনের (২৭) বাড়ি পালাসুতা গ্রামে। আহত শাহজাহান মিয়ার বাড়ি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বাগমারা গ্রামে। তিনি সেলিম মিয়ার ছেলে।

যেই ঘর থেকে ৩ জনকে ধরে নিয়ে গণপিটুনি দেয়া হয়, সেই ঘরটি ছিল নিহত নুরুর শ্বশুর নাবু মিয়ার। ঘটনার পর ১৬ জানুয়ারি কুমিল্লা আদালতে ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে মামলা করেন নুরুর বাবা আব্দুস সালাম। আদালত মুরাদনগর থানার ওসিকে মামলাটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশ দেন। একইভাবে নিহত ইসমাইলের ছোট ভাই লিটন সিকদারও ১৭ জানুয়ারি কুমিল্লা আদালতে ২৭ জনকে আসামি করে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। এই মামলায়ও একই আদেশ দিয়েছেন আদালত।

আদালতের নির্দেশে দু’টি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করছে মুরাদনগর থানার পুলিশ। তবে ঘটনার ৮ মাস পার হলেও তদন্তে এখনো সেদিন ডাকাতির চেষ্টা হয়েছিল কি না তার কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ। এখন হত্যার নেপথ্যে অন্য কারণ খুঁজছে পুলিশ।

একইভাবে সন্দেহের বশে পিটুনিতে আরো ৮ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। প্রতিটি ঘটনায় পৃথক মামলা হয়েছে।

২ যুবককে গণপিটুনিতে হত্যার রাতেই জেলার চান্দিনা-বাগুর বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন দেবীদ্বারের বাগুর শান্তিনগর এলাকার একটি দোকানের টিউবওয়েলের অংশবিশেষ চুরির অভিযোগে আশিকুর রহমান নামের এক তরুণকে ধরে পিটুনি দেয় জনতা। ঘটনার ২ দিন পর ১৪ জানুয়ারি বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়। পেশায় তিনি রিকশাচালক ছিলেন।

৮ই জানুয়ারি মুদি দোকানে চুরির অভিযোগে চান্দিনায় মোজাম্মেল হোসেন সুমন (২৩) নামের আকেক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত সুমন উপজেলার ফরিদপুর গ্রামের রুহুল আমিনের ছেলে।

গত ২৯শে মার্চ ডাকাত সন্দেহে মুরাদনগরে জামাল ওরফে সোহেল (৩১) নামের এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। নিহত জামাল দেবীদ্বারের খয়রাবাদ গ্রামের মতিন সরকারের ছেলে।

২৭শে আগস্ট কুমিল্লা শহরতলির চানপুর এলাকায় চোর সন্দেহে বাবু আলম (২০) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি চান্দিনার আন্নানগর মিলগেট এলাকার মো. শাহজাহান মিয়ার ছেলে। তিনি চানপুর এলাকায় ভাড়াবাড়িতে থাকতেন।

গত ১০ই জুলাই কুমিল্লা নগরীর ঢুলিপাড়া এলাকায় চোর সন্দেহে পিটিয়ে এক ইপিজেড শ্রমিক সাদ্দাম হোসেনকে (৩৫) হত্যা করা হয়। সাদ্দমের বাড়ি মুরাদনগর উপজেলায়। গত বছরের মাঝামাঝি জেলার তিতাসের নোয়াগাঁও গ্রামে চোর সন্দেহে মাহবুবুর রহমান (২৫) নামের আরেক তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

এ ছাড়া গত বছরের ১৩ই অক্টোবর চান্দিনায় মাদক নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করে মো. জুয়েল মিয়াজী (৩২) নামের এক যুবককে তুলে নিয়ে রাতভর গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনে হত্যা করা হয়। গত ৭ই মে কুমিল্লায় এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগে মাহিন মিয়া (২২) নামের এক তরুণকে পিটুনি দেয়া হয়। ৪ দিন পর তাঁর মৃত্যু হয়। মরদেহ বাড়িতে আনার পর মাহিনের বাবা হিরণ মিয়াও (৫০) মারা যান।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লার সভাপতি শাহ মোহাম্মদ আলমগীর খান বলেন, ‘এটি উদ্বেগজনক বিষয়। কোনোভাবেই একজন সাধারণ মানুষ আইন হাতে তুলে নিতে পারে না। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি চুরি-ডাকাতির অভিযোগ থাকে তাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দিতে হবে। অতীতে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সঠিক তদন্ত ও বিচার হতে হবে। তাহলেই এমন ঘটনা কমে আসবে।’

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, বিচারহীনতা ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে এমন ঘটনা বাড়ছে। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে সঠিক তদন্ত ও বিচার হয় না।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) খন্দকার আশফাকুজ্জামান বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এসব ঘটনায় জড়িত জনপ্রতিনিধিরাও গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিশেষ করে এসব ঘটনা রোধে এবং নিজের হাতে আইন তুলে না নেওয়ার জন্য প্রতিটি মানুষকে আমরা বিট ও কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে সতর্ক করে যাচ্ছি। চোর বা ডাকাত সন্দেহে কাউকে আটক করা হলে দ্রæত স্থানীয় থানা পুলিশ বা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করতে আমরা নিয়মিত কাউন্সিলিং করছি।’

Share This