ইসলামে লাইলাতুল কাদর -এর গুরুত্ব


\ ড. মো. মনিরুজ্জামান \
আমাদের দেশে রামাদান মাসের ২৭ তারিখের রাতকে ‘শবে কদর’ বলা হয়। আল-কুরআনে এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। শব ও লাইল উভয়ের অর্থ রাত। সুতরাং লাইলাতুল কাদর বা শবে কদরের অর্থ- ভাগ্য রজনী, মহিমান্বিত রজনী। মূলত কদরের শাব্দিক অর্থ মর্যাদা ও মাহাত্ম্য। অফুরন্ত মর্যাদা ও মাহাত্ম্যের পরপ্রেক্ষিতে এ রাতকে লাইলাতুল কদর বলা হয়। বিখ্যাত ইসলামিক মনীষী আবু বকর ওরবাক (রা.) বলেন, এ রাতের ইবাদত-বন্দেগীর কল্যাণে একজন নগণ্য মানুষও আল্লাহর দৃষ্টিতে মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারে’।
কদরের আরেক অর্থ হলো তকদির (ভাগ্য) ও হুকুম। সৃষ্টির প্রথম দিনে প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে যা কিছু লেখা থাকে, এক রমজান হতে অপর রমজান পর্যন্ত তার সরবরাহের হুকুম ও দায়দায়িত্ব আল্লাহপাক এ রাতেই ফেরেশতাদের দিয়ে দেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাজি.)-এর বর্ণনামতে শবে-বরাতে আল্লাহ এক বছরের জন্য বান্দার রুজি-রিজিক, হায়াত-মউত ও অন্যান্য তকদীরী ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, আর শবে কদরে সে সকল সিদ্ধান্তের প্রয়োগ ও রুজি-রিজিক প্রভৃতি সরবাহের দায়িত্ব আল্লাহ ফেরেশতাদের দিয়ে দেন (কুরতুবী)।
মুহাদ্দিস ইবনে আবি হাতিম (রহঃ) তাফসীরের ইমাম মুজাহিদ (রহঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন সাহাবায়ে কিরামদের বৈঠকে বনি ইসরাইলের এক মুজাদ্দিদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি এক হাজার মাস নিরবচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। এ কথা শুনে সাহাবায়ে কিরামের আফসোস হয় যে, এক হাজার মাস অর্থাৎ তিরাশি বছর চার মাস তো-এ যুগের অনেকে জীবনও পায় না। তাই হযরত মূসা (আঃ)-এর উম্মত বনি ইসরাইলের মতো এতো অধিক সাওয়াব লাভের অবকাশও উম্মতে মুহাম্মদী (সা.)-এর নেই। সাহাবায়ে কিরামের এ আফসোস-অনুশোচনাকালে হযরত জিবরাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ হতে কুরআন মজিদের সূরা কদর নিয়ে হুজুর (সা.)-এর কাছে আগমন করেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এই রাতেই প্রথম নাজিল হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনীতে।
আল্লাহ তায়ালা এ রাতে পূর্ণাঙ্গ কুরআন লওহে মাহফূজ হতে দুনিয়ার আকাশে নাযিল করেন, যা বায়তুল ইজ্জাতে সংরক্ষণ করা হয়। অতপর হযরত জিবরাঈল (আ.) ২৩ বছর ধরে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) এর নিকট তার বিভিন্ন প্রয়োজনীয়তা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্দিষ্ট আয়াত আকারে নাজিল করা হয়। ৬১০ সালে শবে কদরের রাতে মক্কার হেরা গুহায় ধ্যানরত মহানবী, হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর নিকট সর্বপ্রথম কুরআন নাজিল হয়। সর্বপ্রথম তার নিকট প্রথম সূরা আলাক্বের প্রথম পাঁচটি আয়াত নাজিল হয়।
নিশ্চয় আমি এটিকে কদর রজনীতে নাযিল করেছি। আপনি কি জানেন মহিমাময় রাত্রি কী? মহিমান্বিত নিশি সহ¯্র মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাত্রিতে ফেরেশতারা রুহুল কুদুস হজরত জিবরাইল (আ.) সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সকল বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা উদয় পর্যন্ত।’ (সুরা-৯৭ কদর, আয়াত: ১-৫)।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাযিল হয়েছে মানবের দিশারি রূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদর সন্ধান করো।’ (মুসলিম)। এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯। আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়। অর্থাৎ ২০, ২২, ২৪, ২৬ ও ২৮ রমজান দিবাগত রাত্রসমূহ।
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘এই রামাযান মাসটি তোমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। এতে এমন একটি রাত রয়েছে, যা হাযার মাসের চাইতেও উত্তম। যে ব্যক্তি এর কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত হ’ল সে সকল প্রকার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল। আর প্রকৃত বঞ্চিত ব্যক্তিরাই এ থেকে মাহরূম হয়ে থাকে’।
মুফাসসিরিনে কিরাম বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে ৯টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিন তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে বা নয়কে তিনবার যোগ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশ রমজানের রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। (তাফসিরে মাজহারি)। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব?’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তুমি বলবে, আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’(‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করা পছন্দ করেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।’) (ইবনে মাজা, আস-সিলসিলাতুস সহিহাহ, নাসিরুদ্দিন আলবানী)।
কদরের রাত্রের যাবতীয় কাজের ইঙ্গিত দিয়ে এ রজনীর অপার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের অন্যত্র ঘোষণা করেছেন, হা-মীম! শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) এক মুবারকময় রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়। (সূরা আদ-দুখান, আয়াত: ১-৪)
ইসলাম ধর্ম মতে শবে কদরের রাতে ফেরেশতারা ও তাদের প্রধান জিবরাঈল (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করে উপাসনারত সব মানুষের জন্য বিশেষভাবে দোয়া করতে থাকেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, শবে কদরে হজরত জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতাদের বিরাট একদল নিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং যত নারী-পুরুষ নামাজরত অথবা জিকিরে মশগুল থাকে তাঁদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (মাযহারি)
লাইলাতুল কদরে পরবর্তী এক বছরের অবধারিত বিধিলিপি ব্যবস্থাপক ও প্রয়োগকারী ফেরেশতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে প্রত্যেক মানুষের বয়স, মৃত্যু, রিজিক, সবকিছুর পরিমাণ নির্দিষ্ট ফেরেশতাদেরকে লিখে দেয়া হয়, এমনকি কে হজ্জ করবে, তা-ও লিখে দেয়া হয়।
পবিত্র কোরআন নাযিলের মাস রমজান মাস, কোরআন নাজিলের রাত শবে কদর। এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার জাবালে রহমত তথা হেরা পর্বতের গুহায় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে জিবরাইল (আ.) এর মাধ্যমে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর প্রতি কোরআন কারিম অবতীর্ণের সূচনা হয়।
সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাতে ইবাদত করবে; তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ২৫, খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৯-৩০, হাদিস: ৩৪; ই. ফা.)।
শবে কদরে যেসব আমল করা যায়: নফল নামাজ- তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুত, সালাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, সালাতুল হাজাত, সালাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া। নামাজে কিরাআত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা। কোরআন শরিফ: সুরা কদর, সুরা দুখান, সুরা মুজাম্মিল, সুরা মুদ্দাচ্ছির, ইয়া-সিন, সুরা ত-হা, সুরা আর রহমান ও অন্যান্য ফজিলতের সুরা তিলাওয়াত করা; দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; তাওবা- ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; দোয়া কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির আসকার ইত্যাদি করা; কবর জিয়ারত করা। নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি এবং বিশ্ববাসীর মুক্তি কামনা করে দোয়া করা।
এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে অবতরণ করে বান্দাদের ডেকে ডেকে বলেন, ‘কে আছ অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি শেফা দান করব, কে আছ অভাবগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি প্রাচুর্য দান করব, কে আছ বিপদগ্রস্ত আমার কাছে চাও আমি বিপদমুক্ত করে দেব।’
লাইলাতুল কদর পাওয়ার জন্য নবীজি (সা.) শেষের ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। হজরত আয়িশা (রা.) বলেন, ‘ওফাতের আগ পর্যন্ত প্রত্যেক রমজানের শেষের ১০ দিন রাসুল (সা.) ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২৩২৬, মুসলিম: ১১৭২)। ‘কিন্তু তিনি যে বছর ওফাত পান, সে বছর ২০ দিন ইতিকাফ করেন।’ (বুখারি: ৪৯৯৮)। ‘রাসুল (সা.) এর ওফাতের পরও তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারি: ২০২৬, তিরমিজি: ৭৯০)।
এ জন্য সর্বোত্তম পন্থা হলো, শেষ দশদিন ইতিকাফে বসে যাওয়া। তখন লাইলাতুল কদর পেয়ে ধন্য হওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। ইবাদতের পাশাপাশি যাদের সামর্থ্য আছে, তারা দু’হাত উজাড় করে দান করুন। এ মাসে আপনার দান আপনার জন্য কল্যাণের ফল্গুধারা বয়ে দিবে।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। (গ্রামঃ আতাকরা, বাইশগাঁও ইউনিয়ন, মনোহরগঞ্জ, কুমিল্লা)