ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ঈদ আরবী শব্দ। এটি ‘আওদ’ শব্দম‚ল থেকে উদ্ভ‚ত। এর আভিধানিক অর্থ হল ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা, বার বার আসা। মুসলমানদের জীবনে চান্দ্র বৎসরের নির্দিষ্ট তারিখে প্রতি বছরই দু’টি উৎসবের দিন ফিরে আসে। তাই দিন দু’টিকে ঈদ বলা হয়। ফিতর শব্দের অর্থ হলো ভেঙ্গে ফেলা, বিদীর্ণ করা। মুসলমানরা রমজানের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা রাখা আরম্ভ করে এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখার সাথে সাথে রোজা ভেঙ্গে দেয় তথা রোজা রাখা ছেড়ে দেয়। সে কারণে এটিকে ঈদুল ফিতর তথা রোজা ভাঙ্গার আনন্দ বলা হয়।
ঈদুল ফিতরের স‚চনা: রাস‚ল (স.) হিজরত করে দেখতে পান মদিনাবাসী বছরে দু’টি উৎসব পালন করছে। উৎসব দু’টিতে তারা খেলা-ধুলাসহ তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য লালন করছে। উৎসব দু’টির একটির নাম নাইরোজ এবং অপরটির নাম মেহেরজান। নবী (স.) মুসলমানদের জন্য এ দু’টির পরিবর্তে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা নামক দু’ুটি পবিত্র উৎসব প্রবর্তন করেন। হযরত আনাস (রা.) বলেন, মদিনায় নবী (স.) হিজরত করে আসার পর দেখলেন, মদীনাবাসী দু’দিন খুব আনন্দ উৎসব করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুদিনে তোমরা কী কর? তারা বললেন, আমরা জাহিলিয়্যাতের যুগে এ দু’টো দিন খেলাধুলা, আমোদফুর্তি করতাম। নবী (স.) বললেন, আল্লাহতায়ালা তোমাদের এ দু’টো দিনের পরিবর্তে অন্য দু’টি দিন প্রদান করেছেন। তার একটি হলো ঈদুল আযহার দিন ও অপরটি হলো ঈদুল ফিতরের দিন (সনানু আবী দাউদ, হাদীছ নম্বর-১১৩৬)।
ঈদের নামায পড়ার বিধান: দ্বিতীয় হিজরীতে ঈদের নামায ওয়াজিব হয়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, ঈদের নামায পড়ার বিধান নাযিল হওয়ার পর থেকে রাস‚ল (স.) মুত্যু পর্যন্ত কোন বছরই কোন ঈদের নামায পড়া বাদ দেননি। তেমনি খোলাফায়ে রাশিদীনের কেউ তা বাদ দেননি। এর দ্বারা ঈদের নামায ওয়াজিব হওয়া প্রমাণিত হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বর্জন করলে গুনাহগার হবে।
ঈদের নামাযের তারিখ: রমজান শেষে ১ শাওয়াল ঈদুল ফিতরের নামায পড়া ওয়াজিব। তবে যুক্তিসঙ্গত ওজর থাকলে পরের দিন পড়া যাবে। অবশ্য ঈদুল আযহার নামায ওজর থাকলে পরবর্তী দু’দিন পর্যন্ত পড়া জায়েয।
ঈদের নামাযের সময়: স‚র্য আনুমানিক তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠার পর অর্থাৎ স‚র্যোদয়ের ২৩/২৪ মিনিট পর থেকে দ্বি-প্রহরের প‚র্ব পর্যন্ত ঈদের নামাযের ওয়াক্ত। স‚র্য তিন গজ পরিমাণ উপরে উঠা পর্যন্ত সময়টুকুকে তার উদয়কাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময়ে কোন নামায পড়া জায়েয নেই। ঈদুল আযহার নামায অপেক্ষাকৃত আগে এবং ঈদুল ফিতরের নামায কিছু বিলম্বে আদায় করা উত্তম। যেহেতু ঈদুল আযহার নামাযের শেষে কুরবানী দিতে হয়। সেজন্য ঈদুল আযহার নামায যথাশীঘ্রই আদায় করা উত্তম। [সম্পাদনা পরিষদ, ফাতওয়া ও মাসাইল, তৃতীয় খন্ড, ২য় সংস্করণ (ঢাকাঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ১৪১৫ হি./২০০৪ খ্রি.), পৃ. ৩৯৭]।
ঈদের নামাযের স্থান: হযরত আবু সাঈদ আল খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (স.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহে যেতেন এবং সকলকে সাথে নিয়ে ঈদের নামায পড়তেন। অথচ মসজিদে নববীতে এক রাকআত নামাযে এক হাজার, কোন কোন বর্ণনায় দশ হাজার ও পঞ্চাশ হাজার রাকআত নামাযের সাওয়াব লাভের সুসংবাদ রয়েছে। এতদসত্তে¡ও নবী (স.) মসজিদে নববীতে ঈদের নামায না পড়ে সকলকে নিয়ে ঈদগাহে চলে যেতেন এবং সেখানে নামায আদায় করতেন। তাই আলিমদের মত হলো, ঈদগাহে নামায পড়া উত্তম। অবশ্য মসজিদে পড়ে নিলেও ঈদের নামায আদায় হয়ে যাবে, তবে বিনা ওজরে মসজিদে ঈদের নামায না পড়া ভাল (প্রাগুক্ত)।
ঈদের রাতের ফযীলত: যে সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখা যায় সে রাতকে ঈদের রাত বলা হয়। এ রাতের অনেক গুরুত্ব ও ফযীলতের কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
ঈদের খুশী প্রকাশ: ঈদের খুশী হবে অত্যন্ত নির্মল। এতে থাকবে না কোন অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা। থাকবে না কোন সন্ত্রাস ও ভয়-ভীতি। শান্তিপ‚র্ণ অবস্থা বিরাজমান থাকবে। অনেক জায়গায় দেখা যায়, ঈদের চাঁদ উঠামাত্র ছোট বড় অনেকে আতসবাজি আর পটকা নিয়ে মেতে উঠে। এতে ইবাদতকারীদের একাগ্রতা নষ্ট হয়। বাচ্চারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়। অর্থের অপব্যয় হয়। কখনো কখনো বড় দুর্ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। সামান্য অসতর্কতার কারণে আগুন লেগে দোকান পাট অগ্নিদগ্ধ হতে পারে। এমন কি মানুষও মারা যেতে পারে। পটকা ইত্যাদি ক্রয় করার জন্য টাকা পয়সা না দেয়া অভিভাবকদের উচিত। অনুরূপভাবে মসজিদ, ভবন ইত্যাদিতে আলোক সজ্জার ব্যবস্থা করাও অপচয়ের আরেকটি উৎস্য, ইসলামে এর কোন অনুমোদন নেই। এটা বিজাতীয় সংস্কৃতি, হিন্দুদের কুপ্রথা। এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা মুসলমানদের উচিত।
ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য: পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জীবনেই উৎসব রয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের আনন্দ উৎসব পৃথিবীর অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠি-ধর্মের উৎসবের চেয়ে কিছুটা ভিন্নধর্মী। অন্যান্য জাতি-ধর্মের উৎসব হলো খাও দাও ফুর্তি কর। তাদের আনন্দ উৎসব অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় ভরপুর। ইসলাম প্রবর্তিত আনন্দ-উৎসব ইহকালীন ও পরকালীন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপ‚র্ণ। মুসলমানদের ঈদ নিছক উৎসবই নয় বরং এটি একটি গুরুত্বপ‚র্ণ ইবাদতও বটে। এটিই ইসলামের সৌন্দর্য।
মুসলমানদের ঈদের ইহকালীন তাৎপর্য হলো, রমজান শেষে সাদাকাতুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার কুরবানীর চামড়া দিয়ে অসহায়-গরীবদের আর্থিক সহায়তার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। অস্বচ্ছল পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে দু’টি ঈদ যথেষ্ট ভ‚মিকা রাখে। ঈদের পরকালীন তাৎপর্য হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রমজান মাসকে বিভিন্ন ধরনের নিয়ামতে ভরপুর করেছেন। এ মাসেই মহাগ্রন্থ আল কুরআন নাযিল করা হয়েছে। দিনে রোজা রাখার এবং রাত্রিকালীন ইবাদতের মধ্যে অনেক ফযীলতের কথা বিধৃত হয়েছে। লাইলাতুল কদর নামক হাজার রাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ একটি মহিমান্বিত রাত দান করা হয়েছে এ মাসে। পাপ মোচনের এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক সুবর্ণ সুযোগ এসে যায় রমজান মাসে। এ সমস্ত নিয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থা। কাজেই ঈদ নিছক আনন্দ উৎসব নয়, এটি একটি ফযীলতপ‚র্ণ ইবাদত এবং সে কারণেই ঈদের রাতে এবং ঈদের দিনের অনেক ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে হাদীসে।
ঈদুল ফিতর মর্যাদাপ‚র্ণ ইবাদতে পরিণত হবে তাদের জন্য যারা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে রমজানের রোজা পালন করেছে এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে উদ্দেশ্যে রমজানের রোজা ফরজ করেছেন সেই উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে রোজা রেখেছেন তথা তাকওয়া অর্জন করেছেন। যারা পাপমুক্ত জীবন গঠনের মানসিকতা অর্জন করেছে এবং যারা ইসলামের নির্দেশনার গন্ডির মধ্যে থেকে আনন্দ উৎসব পালন করেছে অর্থাৎ যাদের আনন্দ উৎসবে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা নেই। প্রকৃতপক্ষে এ ঈদ হলো এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনের দীর্ঘ মেয়াদী প্রশিক্ষণ কোর্সের সমাপ্তি অনুষ্ঠান। পরবর্তী এগারো মাস সেই প্রশিক্ষণ অনুযায়ী জীবনের বাঁকে বাঁকে চলার এক সফল প্রতিশ্রæতি। তাই একদিকে ঈদুল ফিতর যেমন সিয়াম সাধনার সমাপ্তি ঘোষণা করে, অপরদিকে তা নির্মল আনন্দও বয়ে আনে। প্রকৃত রোজাদারদের জন্য রাসুলুল্লাহ (স.) এর ঘোষণা হলো, ‘যারা যথাযথভাবে সিয়াম সাধনা করে তারা ঈদের নামায শেষে নবজাতক শিশুর ন্যায় পাপমুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন’।
ঈদের দিনের সুন্নাত ও মুস্তাহাবসম‚হ: ঈদুল ফিতরের দিন নিম্নলিখিত কাজগুলো সম্পাদন করা মুস্তাহাব। ১. নিজ মহল্লার মসজিদে ফজরের নামায আদায় করা। ২. মিসওয়াক করা। ৩. গোসল করা। ৪. খুশবু ব্যবহার করা। ৫. সাদাকাতুল ফিতর নামাযের প‚র্বেই আদায় করা। ৬. সাধ্যানুযায়ী উত্তম পোশাক পরিধান করা। ৭. খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা। ৮. ঈদের ময়দানে যাওয়ার প‚র্বে কিছু নাশতা করা। ৯. মিষ্টি জাতীয় ও বিজোড় সংখ্যার খেজুর দিয়ে নাশতা করা। ১০. সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পরিমাণ দান সাদকা করা। ১১. আগেভাগে ঈদগাহে যাওয়া। ১২. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। ১৩. ঈদগাহে এক পথে যাওয়া এবং অপর পথে ফিরে আসা। ১৪. ঈদগাহে যাওয়ার সময় চুপে চুপে তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা।