শনিবার, ৭ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কুরবানির গুরুত্ব ও শিক্ষা: ইসলামের আলোকে একটি পর্যালোচনা

কুরবানির গুরুত্ব ও শিক্ষা: ইসলামের আলোকে একটি পর্যালোচনা
৫৯ Views

\ মাসুম বিন নোমান \

            ভূমিকা:

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানব জীবনের প্রতিটি দিকের দিকনির্দেশনা প্রদান করে। কুরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত যা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত হয়। এটি একদিকে যেমন তাকওয়ার পরিচায়ক, তেমনি অন্যদিকে সমাজে সহানুভূতি ও সহযোগিতার শিক্ষা দেয়।

কুরবানির পরিচয়:

আরবি “কুরবান” শব্দটি কুরবুন মূল ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ নিকটবর্তী হওয়া। কুরআনের পরিভাষায় কুরবানি বলতে বোঝায়- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট সময় ও নিয়ম অনুযায়ী পশু জবেহ করা। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে:

“তোমরা প্রত্যেক জাতির জন্যই আমি কুরবানির বিধান রেখেছি, যাতে তারা নির্দিষ্ট পশুগুলোর ওপর আল্লাহর নাম স্মরণ করে, যা তিনি তাদের দিয়েছেন।” (সূরা আল-হাজ্জ: ৩৪)

কুরবানির ইতিহাস:

কুরবানির মূল ভিত্তি হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর ত্যাগ ও আনুগত্যের এক বিস্ময়কর অধ্যায়। আল্লাহর পক্ষ থেকে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-কে পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কুরবানি করার আদেশ দেয়া হলে তিনি কোন দ্বিধা না করে সেই আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত হন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর এই নিঃস্বার্থ আনুগত্যের প্রতিদানে ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে জান্নাতি একটি পশু কুরবানি হিসাবে কবুল করেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করে মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর ঈদুল আযহায় পশু কুরবানি করে থাকে।

কুরবানির গুরুত্ব:

কুরআনে আল্লাহ বলেন: “আল্লাহর নিকট তাদের গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭)

রাসূল (সা.) বলেন:

“কুরবানির দিন কোনো আমল আল্লাহর নিকট পশু কুরবানির চেয়ে অধিক প্রিয় নয়।” (তিরমিজি, হাদীস: ১৪৯৩)

১. আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়:

কুরবানি হচ্ছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি ইবাদতের একটি রূপ, যার মাধ্যমে বান্দা নিজের অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় করে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।

২. ইব্রাহিমী ত্যাগের স্মারক:

কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানরা নবী ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও আনুগত্যের মহান নিদর্শনকে স্মরণ করে। এটি মুসলমানদের আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকার মানসিকতা তৈরি করে।

৩. ঈদের গুরুত্বপূর্ণ আমল:

ঈদুল আযহার অন্যতম প্রধান আমল হলো কুরবানি। রাসূলুল্লাহ (সা.) কুরবানি না করে ঈদের দিন ঈদগাহে না যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করেছেন। (তিরমিজি)

৪. সুন্নাতে মুয়াক্কাদা:

হাদীসের আলোকে অধিকাংশ ইসলামি ফকীহগণ কুরবানিকে ‘সুন্নাতে মুয়াক্কাদা’ বলেছেন, অর্থাৎ এমন একটি নিয়মিত সুন্নাহ, যা রাসূল (সা.) কখনো পরিত্যাগ করেননি এবং পরিত্যাগ করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন।

৫. আখিরাতের প্রতিদান:

কুরবানির পশুর প্রতিটি লোম, রক্তকণা ও খর্বাংশের বিনিময়ে সওয়াব প্রদান করা হয়। রাসূল (সা.) বলেন:

“তোমরা কুরবানি করো, কেননা তা তোমাদের পূর্বসূরি ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নাহ।” (ইবনু মাজাহ)

এ হাদীস ও আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, কুরবানি শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত এক আত্মত্যাগের বহিঃপ্রকাশ।

কুরবানির শিক্ষাসমূহ:

১. আনুগত্য ও ত্যাগের শিক্ষা:

হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর ঘটনা থেকে শিক্ষা পাই, আল্লাহর আদেশ পালনে প্রিয়তম জিনিসও ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকা চাই।

২. তাকওয়ার বিকাশ:

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই কুরবানির মূল উদ্দেশ্য। এতে খাঁটি নিয়ত ও আন্তরিকতার প্রয়োজন হয়, যা মানুষকে পরহেজগার ও আত্মনিয়ন্ত্রণশীল করে তোলে।

৩. সহানুভূতি ও সাম্যবোধ:

কুরবানির মাধ্যমে ধনী-গরিবের মাঝে পারস্পরিক সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। গরিবরা ঈদের দিন পুষ্টিকর খাদ্য পায়, যা সমাজে সাম্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে।

৪. নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা:

কুরবানি একটি নির্দিষ্ট সময় ও নিয়ম অনুযায়ী করতে হয়। এটি আমাদের জীবনে শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতার শিক্ষা দেয়।

৫. আত্মত্যাগের প্রেরণা: কুরবানি আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর নির্দেশ পালনে প্রয়োজন হলে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় বস্তুও ত্যাগ করতে হবে।

৬. আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা:

ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর হুকুমে ছেলেকে কুরবানি করতে গিয়েছিলেন- এতে আমরা শিখি, আল্লাহর আদেশের পেছনে সবসময় কল্যাণ নিহিত থাকে, যদিও তা আমাদের দৃষ্টিতে কঠিন মনে হয়।

৭. সমাজে সহানুভূতির চর্চা:

কুরবানির মাংসের একটি অংশ গরিব ও অভাবীদের মাঝে বিতরণ করতে হয়। এটি ধনীদের হৃদয়ে দরিদ্রদের প্রতি সহানুভূতি ও দানশীলতা বৃদ্ধি করে।

৮. ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা:

ঈদুল আযহার সময় মুসলিমরা একসাথে ঈদের নামাজ আদায় করেন এবং কুরবানিতে অংশগ্রহণ করেন। এতে মুসলিম সমাজে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয়।

৯. তাকওয়ার অনুশীলন: আল্লাহ কুরআনে বলেন, “আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তার মাংস ও রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ: ৩৭)

অর্থাৎ, কুরবানির মাধ্যমে তাকওয়ার বাস্তব অনুশীলন হয়- নিজেকে আত্মনিয়ন্ত্রণে রেখে খাঁটি নিয়তে ইবাদত করা।

১০. সম্পদ ব্যবস্থাপনার শিক্ষা:

কুরবানি করতে হলে একজনকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে হয় (নিসাব)। এটি একজন মুসলমানকে নিজের অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে সচেতন করে এবং ইসলামী অর্থনৈতিক নিয়মকানুন বোঝার সুযোগ করে দেয়।

            পরিশেষে বলা যায় যে, কুরবানি ইসলামের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত, যা আত্মিক পরিশুদ্ধি, সমাজিক সংহতি এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্যের প্রতীক। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে কুরবানি শুধু একটি রীতি নয়, বরং তা একটি শক্তিশালী জীবনদর্শনের অনুশীলন। তাই আমাদের উচিত এ ইবাদতের অন্তর্নিহিত শিক্ষা উপলব্ধি করে বাস্তব জীবনে তা প্রয়োগ করা।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক (আরবি), ফুলগাঁও ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা।

Share This