দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে বোরো উৎপাদনে সর্বোচ্চ নজর দিচ্ছেন সরকার
ষ্টাফ রিপোর্টার\ কুমিল্লা, ফেনীসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ১২টি জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় ১৪ হাজার ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে কৃষি সংশ্লিষ্ট খাতে ক্ষতি হয়েছে ৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। প্রায় ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। মৎস্য খাতের ক্ষতি ১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা এবং প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৯৭৮ কোটি টাকারও বেশি। অন্তর্র্বতী সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম গত ১৭ই সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চলতি বছর ২০শে আগস্ট আকস্মিক বন্যায় ১৪ হাজার ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ৯ লাখ ৪২ হাজার ৮২১ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৭৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৬৮ জন। এ বন্যার ফলে কৃষিতে যে ক্ষতি হয়েছে তাতে আগামীতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক কৃষিসেবা বিভাগের ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) চলতি মাসের গেøাবাল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্কের (গেইন) ‘গ্রেইন অ্যান্ড আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার বন্যায় বাংলাদেশে প্রায় তিন লাখ হেক্টর জমির আউশ ও আমন আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার এই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দেশের চাল উৎপাদনে। এবার আউশ মৌসুমে তিন লাখ টন এবং আমন মৌসুমে চার লাখ টন, সব মিলিয়ে চালের উৎপাদন কম হতে পারে সাত লাখ টন। এতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রায় পাঁচ লাখ টন চাল আমদানি করা লাগতে পারে। তবে সরকার এ ঘাটতি মেটাতে আগামী বোরো মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দিতে চায়।
বন্যাদুর্গত এলাকার কৃষকদের ঋণের কিস্তির টাকা আপাতত তিন মাস স্থগিত করেছে সরকার। একই সাথে কৃষকদের সার, বীজসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণে প্রনোদনা দেয়ারও এ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার কৃষি পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। শুধু অগ্রাধিকারই নয়; নগদ ও উপকরণ সহায়তা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর কৃষি খাতকে গতিশীল করার জন্য এরই মধ্যে রাজস্ব বাজেট থেকে প্রায় ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই বরাদ্দের আওতায় কৃষকদের ধাপে ধাপে নগদ অর্থ ও বিনামূল্যে সার-বীজের মতো কৃষি উপকরণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। যাতে বন্যায় ভেঙে যাওয়া কৃষকের মনোবল দ্রæত ফিরে আসে এবং আবার মাঠে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় খাদ্য নিরাপত্তাই নিশ্চিত হবে না, দ্রæত কৃষি খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।
দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ১৪ লাখেরও বেশি কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এসব কৃষকের দুই লাখ ৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে ৭ লাখ ১৪ হাজার টনেরও বেশি। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ তিন হাজার ৩৪৫ কোটি। ভয়াবহ এই বন্যার পর, কৃষি পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে নতুন করে আমন চাষে। কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃষি পুনর্বাসন। যে কারণে ফসল নষ্ট হওয়া জমিগুলো দ্রæত চাষের আওতায় আনতে কাজ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই। এই কার্যক্রমের আওতায় ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আশপাশে দ্রæত আমনের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে, যা দিয়ে পুনরায় আমনের আবাদ করা হবে। এ ছাড়া শাক-সবজিসহ অন্যান্য জমিতেও চাষাবাদ ফিরিয়ে আনতে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেয়ার জন্য কাজ চলছে।
সব মিলিয়ে, অন্তর্র্বতী সরকার এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি নিয়ে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এই কর্মসূচির মধ্যে তাৎক্ষণিক সহায়তা যেমন রয়েছে, তেমনি আসন্ন রবি মৌসুমের জন্যও রয়েছে নানা ধরনের সহায়তা। তাৎক্ষণিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ বিনামূল্যে ধানের বীজ, সার ও নগদ এক হাজার করে টাকা প্রদান। এই কর্মসূচিতে কৃষি উপকরণ হিসেবে প্রত্যেক কৃষককে বিনামূল্যে পাঁচ কেজি করে স্বল্পমেয়াদি ব্রি-৭৫, বিনা-১৭ জাতের বীজধান, ১০ কেজি করে ডিএপি ও এমওপি সার দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া দেয়া হচ্ছে নগদ এক হাজার করে টাকা। এই কর্মসূচিতে মোট ৮০ হাজার কৃষককে (প্রত্যেককে ১ বিঘা জমি) বীজ ফসল, বীজ ধান অথবা বীজ দেয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বীজ ধান দেয়া হয়ে গেছে। সঙ্গে দুই রকমের সার ও এক হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচিতে মোট ৯টি জেলার ৮০ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের বিনামূল্যে রোপা আমনের বীজ ও সারসহ ১৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পরবর্তী ধাপে ২২ জেলার দেড় লাখ কৃষককে আগাম রবিশস্য করার জন্য বীজ ও নগদ এক হাজার টাকা করে দেয়া হবে। তাদের প্রত্যেককে ৫ শতাংশ জমিতে আগাম শীতকালীন সবজি চাষের জন্য এই সহায়তা প্রদান করা হবে।
তবে অন্তর্র্বতী সরকার আগামী বোরো আবাদ এবং উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এজন্য মৌসুসের শুরুতেই বোরো আবাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি প্রান্তিক কৃষককে ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি সার ও এক হাজার টাকা করে দেয়া হবে। এগুলো রাজস্ব খাত থেকে দেয়া হচ্ছে। এর জন্য ২২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। এর বাইরে পণোদনা খাত থেকেও দেয়া হবে।
এবারের ভয়াবহ বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, ল²ীপুর, কুমিল্লা, চট্টগাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। ফলে এসব জেলার কৃষকও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কক্সবাজার এবং রাঙ্গামাটি জেলার ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এসব জেলার খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারও কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সংখ্যা ও ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণ করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও অবকাঠামো মেরামত সময় সাপেক্ষ হলেও, সরকার চাইছে দ্রæত পুনর্বাসন কর্মসূচির মাধ্যমে কৃষকদের আবার কৃষি কাজে ফিরিয়ে আনতে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের পুনর্বাসন কর্মসূচির পরিকল্পা প্রণয়ন করা হয়েছে। আসন্ন রবি মৌসুমে কৃষক যাতে সবজি এবং বোরো আবাদ করে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে সে জন্য আর্থিক ও কৃষি উপকরণ সহায়তা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে কোনো কোনো জেলায় এই পুনর্বাসন কর্মসূচি শুরু হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া বলেন, বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শুরু থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে। দুর্গত এলাকায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠে রয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পাশে সব রকমের সহায়তা দ্রæত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কৃষি সচিব বলেন, আমরা মনে করছি, দু’-চারটি জেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা পুষিয়ে উঠতে পারব। এ ছাড়া আগামী বোরো মৌসুমে যদি আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে পারি, তা হলে আমার মনে হয় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারব। এ জন্য আসন্ন রবি ফসলের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হবে।