দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ প্রয়োজন

ড. মনজুর আলম॥ এক রক্তঝরা বিপ্লবের পর হাজার মানুষের আত্মাহুতি, হাজার হাজার আহত মানুষের আর্তনাদ ও অঙ্গহানির যন্ত্রণা, গুম-খুন আর কোটি মানুষের কষ্টের ওপর এ অন্তর্র্বতী সরকার দাঁড়িয়ে-তাই জনগণের আকাঙ্খা ও প্রত্যাশাও এ সরকারের ওপর অনেক বেশি। যদিও অনেক ক্ষেত্রে এ প্রত্যাশা মাত্রাতিরিক্ত। তবে কিছু প্রত্যাশা আছে, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই অন্তর্র্বতী সরকারকেই নির্ধারণ করতে হবে কীভাবে ও কেমন করে সেসব প্রত্যাশা পূরণ করা যায়। প্রত্যাশা পূরণে কী কী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
যেহেতু এ সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল এবং তারাই বর্তমান সরকারের মুখ্য সমর্থক, তাই ছাত্র-জনতার সমর্থন ধরে রাখতে হলে তাদের আকাঙ্খাকে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গত ১৬ বছরে যত মানুষ ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন, সঠিক তালিকা প্রস্তুত করে ভুক্তভোগী পরিবারকে সম্মানি প্রদানের ঘোষণা ও সব আহতের সুচিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা হবে সে আকাঙ্খা পূরণের প্রথম পদক্ষেপ। এ কাজ অবশ্য শুরু হয়েছে। তবে ১৬ বছরে যারা শহিদ হয়েছেন, তাদের সবাইকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
সহায়তা সংক্রান্ত যে কাজ, তা অত্যন্ত পরিকল্পিত ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে হওয়া প্রয়োজন। যেখানে শহিদদের তালিকা ও প্রদেয় অর্থ, আহতদের প্রদেয় অর্থ, চিকিৎসা কেন্দ্র ও চিকিৎসা বাবদ খরচের বিশদ বিবরণ থাকবে এবং নিয়মিত সংবাদমাধ্যমে প্রচার হবে। এতে সরকারের জবাবদিহিতা হবে, উজ্জ্বল হবে ভাবমূর্তিও। আমার মতে, অন্তর্র্বতী সরকারকে জনসমর্থন ধরে রাখতে হলে দু’টি মুখ্য প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে : ১. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বা সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা, ২. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন। জনগণের দৃষ্টিতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের ওপরই বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন অনেকাংশে নির্ভর করে। তবে সরকার এক্ষেত্রে কতটুকু সাফল্য অর্জন করেছে, তা তারাই বিবেচনা করতে পারে। উল্লিখিত দু’টি প্রত্যাশার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রত্যাশা তো রয়েছেই। যেমন-সুষ্ঠু ভোট ব্যবস্থাপনা ও সরকারের বিভিন্ন রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কার ইত্যাদি।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ, তাই প্রথমেই দেখা যাক দ্রব্যমূল্য ব্যবস্থাপনা বা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সাধারণ চিত্র: কৃষিপণ্য উৎপাদকের বিক্রয় মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও আমদানি মূল্য বা আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের দামানুপাতে জনগণকে অনেক বেশি মূল্যে কিনতে হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে?
বিভিন্ন পণ্যের (এখন প্রায় প্রতিটি পণ্যের) সিন্ডিকেটের কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। প্রকৃত অর্থে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব, বিবিধ পণ্যের বর্তমান উৎপাদন ও চাহিদার তারতম্য, সঠিক নির্দেশনার অভাব, জটিল আমদানি নীতি, বাজার ব্যবস্থাপনায় তদারকি ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি এ অবস্থার জন্য দায়ী, তাই :
১. বহুমাত্রিক আমদানি, আমদানি সহজীকরণ ও খাদ্য চাহিদার বিজ্ঞানসম্মত পূর্বাভাসের সামঞ্জস্য বিধান জরুরি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বিভাগ সার্বক্ষণিক এ কাজটি তদারক করে, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি খাদ্য ঘাটতিসংক্রান্ত পূর্বাভাসের আলোকে কোনো খাদ্যদ্রব্য অপ্রতুল হবে বলে প্রতীয়মান হলে যথাসময়ে আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যাতে খাদ্য অপ্রতুলতাকে পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটতে বা বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে।
২. উৎপাদক ও আমদানিকারক থেকে ভোক্তা অবধি প্রতিটি স্তরে পর্যবেক্ষণ (মনিটরিং) ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে পণ্য সরবরাহের কোনো স্তরই বাধাগ্রস্ত বা কেউ অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে। সেটি করলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল নির্বিশেষে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৩. সরকার সব ধরনের বেআইনি সিন্ডিকেট কার্যক্রম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য করে বিশেষ বিধান জারি করতে পারে। এর আওতায় সিন্ডিকেট সদস্যের কার্যক্রম বেআইনি করে দোষীর প্রাপ্ত সাজার ওপর (তার ও পরিবারের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ) যথাসম্ভব স্বল্পসময়ে বাজেয়াপ্ত করার বিধান থাকবে, যাতে সবাই বুঝতে পারে লাভের তুলনায় ঝুঁকি ও লোকসানের পরিমাণ অনেক বেশি।
৪. অর্থ পাচার সম্পর্কিত আইনকে যুগোপযোগী, কঠোর ও কঠিন করতে হবে, যাতে সিন্ডিকেট সদস্যরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে মুক্তি পেতে না পারে। অর্জিত অনৈতিক ও বেআইনি সম্পদ দেশের বাইরে পাচার করতে না পারে।
৫. সরকার দেশের সব সীমানায় এবং সব অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রেড এলার্ট জারি করবে, যাতে সিন্ডিকেট সদস্যরা বা তাদের এজেন্টরা কালো টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যেতে না পারে। এক্ষেত্রে সরকার আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও চাইতে পারে। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান টাকা পাচারে সহায়তা করলে যেন কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়।
৬. স্থানীয় প্রশাসনকে আস্থায় নিয়ে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, সাধারণ ব্যবসায়ী ও দল-মত নির্বিশেষে আগ্রহী ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলায় উৎসাহ দিতে হবে। যাতে সিন্ডিকেটের বেআইনি কার্যক্রমের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ, আদান-প্রদান ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেট ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনমত একাট্টা থাকে।
৭. যেহেতু এ সরকার ছাত্র-জনতার সংগ্রামের ফসল, সুতরাং সব কর্মকান্ডে ছাত্র-জনতাকে সম্পৃক্ত করা এ সরকারের দায়িত্বও বটে! সিন্ডিকেটের থাবা থেকে দ্রব্যমূল্যের সরবরাহ ও বিতরণ ব্যবস্থাকে মুক্ত করে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য ‘কমিউনিটি ওয়াচ প্রোগ্রামে’র ব্যাপারে সরকার চিন্তা করতে পারে। যেখানে কমিউনিটি প্রোগ্রামের সদস্যরা (বিশেষ করে তরুণ সমাজ, ছাত্র ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা) সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সিন্ডিকেট ও তাদের এজেন্টদের কর্মকান্ড সম্পর্কে তথ্য প্রদান করবে। সাধারণ মানুষও এ কাজে এগিয়ে আসতে পারে। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সিন্ডিকেট ও তার এজেন্টদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করবে (এ ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয় বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত বিচার নিশ্চিত করবে)।
৮. পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থার ওপরে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কমিউনিটি প্রোগ্রাম সদস্যদের সহযোগিতা অনেকাংশে নির্ভরশীল, তাই সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে, যাতে পারস্পরিক সহযোগিতা, শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত হলে কমিউনিটি প্রোগ্রাম সদস্যরা যেমন অনুপ্রাণিত হবে সেইসঙ্গে সিন্ডিকেট ও তাদের এজেন্টদের নিরুৎসাহিত করবে।
৯. বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে, সিন্ডিকেটের বেআইনি কাজে প্রজাতন্ত্রের যে কারও সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হলে কঠিন শাস্তি নিশ্চিত তরা। তাদের হয়ে তদবির করলেও একই শাস্তি। মনে রাখতে হবে, শাস্তি নিশ্চিতকরণের ওপরই এ ব্যবস্থার সফলতা নির্ভরশীল।
১০. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির অংশ হিসাবে যারা অনৈতিক সিন্ডিকেটের সদস্য, তাদের এজেন্ট, মদদদাতা ও অর্থের জোগানদাতাদের দুর্নীতিসংক্রান্ত অপকর্মের খবর, সেইসঙ্গে কমিউনিটি সদস্যদের সাফল্য (নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে) প্রচারে সংবাদমাধ্যমকে উৎসাহিত করা।
১১. দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের অপরিহার্যতা সম্পর্কে যেহেতু দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল সহমত, তাই প্রয়োজনে তাদের সম্পৃক্ত করেই বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করা জরুরি, যা ভোক্তা অধিকার আইন বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আইনের সম্পূরক হতে পারে!
উপসংহারে বলা যায়, দীর্ঘদিনের সৃষ্ট দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া এত সহজ নয়। এর সঙ্গে সন্ত্রাস, প্রভাব, দুর্নীতি ও অপরাজনীতিও জড়িয়ে আছে। কিন্তু যদি ভেঙে দেয়া যায়, তবে নিশ্চয়ই দ্রব্যমূল্য সহনশীল পর্যায়ে আসবে। দ্রব্যমূল্য ক্রয়, আমদানি ও বিক্রয় ব্যবস্থায় অধিকতর প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে এবং ভোক্তা তুলনামূলক ন্যায্যমূল্যে দ্রব্যাদি কিনতে পারবে। পণ্য ক্রয়, আমদানি, পণ্যের গুণগতমান, পণ্য-বহুমুখীকরণ ও বাজার ব্যবস্থায় সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। বাজারব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও সৃজনশীলতার উন্মেষে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সম্পদ কুক্ষিগতকরণের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বাজার ব্যবস্থায় নতুন ব্যবসায়ীরা যোগ দিতে উৎসাহ পাবে! সর্বোপরি ভোক্তা বা জনগণ তুলনামূলক ও সঠিক দামে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারবে।
দেশের সব বিবেকবান মানুষ যার যার অবস্থান থেকে সহায়তা করলে এবং সরকার উপরোল্লিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলে অবশ্যই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়