নিউইয়র্কে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলামের জানাজায় হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায়


শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম (৩৬)কে গভীর শোক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় শেষ বিদায় জানিয়েছেন হাজারো মানুষ। গত ৩১শে জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে নিউইয়র্ক সিটির পার্কচেস্টার এলাকায় আয়োজিত আনুষ্ঠানিকতায় তাকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগ (NYPD)। একই সঙ্গে তাকে মরণোত্তর ‘ডিটেকটিভ ফার্স্ট গ্রেড’ পদে উন্নীত করা হয়। নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ক্যাথি হকুল, সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস, পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশসহ পুলিশ বিভাগের হাজারো কর্মকর্তা এবং সাধারণ মানুষ অংশ নেন দিদারুল ইসলামের শেষ বিদায়ের এই আয়োজনে। যেখানে তার জানাজায় অংশ নেন হাজারো মুসল্লি। জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয় পার্শ্ববর্তী স্টেট নিউজার্সির টোটোওয়া ইসলামিক কবরস্থানে।
বলা বাহুল্য, নিউজার্সির উক্ত লোরেল গ্রোভ কবরস্থান এলাকাটা একটি পুরনো, শান্ত, ইতিহাসঘেরা প্রান্তর। যেখানে ১৮০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে নানা জাতি-ধর্মের মানুষ চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন। এ বিশাল কবরস্থানের ভেতর বিভিন্ন কমিউনিটি নিজেদের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট জমি কিনে রেখেছেন। যেন আপন আপন সংস্কৃতির মানুষদের সমাহিত করা যায় পরিচিত পরিবেশে। বাংলাদেশি মুসলমানদেরও তেমন কিছু জায়গা আছে সেখানে; এক শান্ত অথচ গর্বিত নিঃশ্বাসে, চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন সময়ের বীর, আমাদের দিদারুল ইসলাম। তদুপরি প্রায় প্রতিদিনই এখানে দেখা যায় স্বদেশি মানুষদের- কারো পিতামাতার কবর, কারো ভাই-বোন কিংবা প্রিয়জন। কেউ আসে কোরআন পড়তে, কেউ শুধু দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ।
প্রকাশ থাকে যে, গত ২৮শের জুলাই সোমবার বিকেলে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের পার্ক অ্যাভিনিউতে এক বহুতল ভবনে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় এক বন্দুকধারী। এই হামলাকারীকে থামাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন পুলিশ কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম।
দিদারুল পুলিশ বিভাগ-অনুমোদিত একটি প্রাইভেট নিরাপত্তা দায়িত্বে ছিলেন। ইউনিফর্ম পরে কাজ করছিলেন- ঠিক তখনই ঘটে উক্ত বন্দুকধারীর নারকীয় হামলা। ওই ঘটনায় আরও চারজন নিহত হন। দিদারুল ইসলামের মরদেহ পার্কচেস্টার জামে মসজিদ ফিউনারেল হোমে আনা হয় পরদিন ২৯শে জুলাই।
তখন নিউইয়র্কের ব্রংকসের পার্কচেস্টার জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সকাল থেকেই জড়ো হতে থাকে হাজারো মানুষ। আমেরিকার নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পুলিশ সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এবং সাধারণ মানুষ- সবাই দাঁড়িয়ে ছিলেন বীরকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
জানাজা পড়ান পার্কচেস্টার জামে মসজিদের সাবেক ইমাম মাওলানা মঈনুল ইসলাম।
জানাজার নামাজের আগে বক্তব্য রাখেন, নিউইয়র্ক স্টেটের গভর্নর ক্যাথি হকুল, সিটি মেয়র এরিক অ্যাডামস, পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ, প্রিসিনকটের কমান্ডিং অফিসার আশরাফ জাহাঙ্গীরসহ অন্যান্য প্রশাসনিক ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। তাঁদের প্রত্যেকের কণ্ঠেই ছিল দিদারুলের আত্মত্যাগের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা। বারবার উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশের নাম, স্মরণ করা হয়েছে দিদারুলের উৎস, তাঁর শিকড়। বক্তারা দিদারুলের স্ত্রী ও সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নাম বলে তাদের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছিলেন।
মেয়র এরিক এডামস বলেছেন, ”একজন মানুষের কোটি মাইল পাড়ি দিয়ে, এক অটোমেটিক অস্ত্র নিয়ে এসে নিরপরাধ প্রাণ নিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা আমাকে বারবার প্রশ্ন করে- আমরা আরও কী করতে পারতাম?”
পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশ বলেন, “দিদারুল আমাদের জন্য যা করছিলেন, সেটাই তাঁর কর্তব্য ছিল। জীবনকে বাজি রেখে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যদের রক্ষা করেছেন। তিনি যেমন দায়িত্ববান ছিলেন, তেমনই ছিলেন এক নিঃস্বার্থ বীর।”
দিদারুল ইসলামের নিহত হওয়ার পর থেকেই নিউইয়র্ক পুলিশের বাংলাদেশি অফিসারদের সংগঠন বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)’র কর্মকর্তারা দিনরাত কাজ করেছেন তাদের সহকর্মীর দাফন না হওয়া পর্যন্ত।
বাপার মিডিয়া লিয়াজো অফিসার জামিল সারওয়ার, প্রেসিডেন্ট এরশাদ সিদ্দিকী, সেক্রেটারি রাশেদ মালেক, ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রিন্স আলম এবং ইভেন্ট কোঅর্ডিনেটর শেখ মুরাদ আহমেদ সার্বক্ষণিক সংবাদমাধ্যম, নগর কর্তৃপক্ষ ও দিদারুলের পরিবারের সাথে সংযোগ রক্ষা করেছেন। মসজিদ প্রাঙ্গণে কান্না ছড়িয়ে পড়ে যখন উঠে আসে দিদারুলের বাবা-মা, বিধবা স্ত্রী, তাঁর দুই শিশু সন্তান এবং গর্ভে থাকা অনাগত সন্তানের প্রসঙ্গ। তখন বুকফাটা আর্তনাদে ভেঙে পড়েন অনেকেই।
জানাজার পরে, পতাকা মোড়ানো কফিনটি যখন বাইরে আনা হয়, তখন হঠাৎ করেই আকাশ ভেঙে নামে বৃষ্টি। যেন প্রকৃতিও কাঁদছিল একজন সৎ, নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসারের বিদায়ে। পুলিশের গাড়ির বহর, আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, সাধারণ মানুষ- সবাই মিলিত হন দিদারুলের শেষ যাত্রায়। ব্রংকস থেকে নিউ জার্সির টোটোয়া অব্দি চলে এই অন্তিম শোভাযাত্রা।
পুলিশ অফিসার দিদারুল ইসলামকে দাফন করা হয়েছে, নিউ জার্সির লোরেল গ্রোভ কবরস্থানে। সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতায় উচ্চারিত হয়- “আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।”
পুলিশ সদস্যরা শেষ স্যালুট জানান তাঁদের এক ঝরে যাওয়া কমরেডকে। কবরস্থানের পতাকা অর্ধনমিত হয়ে যেন বলছিল-বিদায় বীর!
আর এই দিদারুল ইসলামই হলেন- নিউইয়র্ক পুলিশের ইতিহাসে প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান, যিনি লাইনে অফ ডিউটিতে শহীদ হলেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের বড়লেখা থেকে আসা এক তরুণ, মাত্র বিশ বছর বয়সে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। ২০১৯ সালে স্কুল সেফটি এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করে মাত্র চার বছরেই হয়ে উঠেছিলেন নিউইয়র্ক পুলিশের অন্যতম উদীয়মান সদস্য। তিনি স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেছিলেন পুলিশ বাহিনীতে যোগদানের পর থেকেই। অসংখ্য মানুষজন মহান আল্লাহর দরবারে দিদারুল ইসলামের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেছেন। Courtesy: usanewsonline/ Mohammed Shakhawat Hossain Salim