ফিলিস্থিন ইসরাইল যুদ্ধ এবং ইরানের ভূমিকা
মোঃ জামাল হোসেন\ বিগত ৭ই অক্টোবরের পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। ইসরাইলিদের প্রতিশোধ স্বরুপ এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজারের অধিক নিরীহ ফিলিস্থিনিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এদের অধিকাংশই শিশু ও নারী। ক্রমাগত ট্যাংক ও কামান থেকে গোলা বর্ষণ ও বিমান হামলায় এ সব শিশু নারী নিহত হয়। পুরো পশ্চিম তীর ও গাজা প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে। এখন রাফা সীমান্তে হামলা হচ্ছে। ৮০% ঘরবাড়ি এবং স্থাপনা বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। বর্বর ইসরাইলি বাহিনী (আইডিএফ) মসজিদ গীর্জা এবং হাসপাতালগুলোকেও হামলার লক্ষ্য বস্তু থেকে রেহাই দেয়নি। গাজার গণকবর থেকে অনেক জীবিত ফিলিস্থিনিদের বীভৎস লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। রাফায় লক্ষ লক্ষ ফিলিস্থিনি উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। ইসরাইল ত্রাণ ও মানবিক সাহায্যের ট্রাক তথায় প্রবেশ করতে না দেওয়ায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিরীহ ও আশ্রয়হীন ফিলিস্থিনিদের আহাজারি রোনাজারিতে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হচেছ প্রতি মুহূর্তে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল নামক ইহুদি অবৈধ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন জাতিসংঘের ভোটাভোটির মাধ্যমে এ রাষ্ট্রটি বৈধতা পায়। প্রথম মহাযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) অটোমান সা¤্রাজ্য ধ্বংস এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) ইহুদিরা মিত্রশক্তির জয় লাভে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তখন ইহুদিরা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাস করত। তাদের নিজস্ব কোন আবাস ভূমি ছিলনা। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে এসে ফিলিস্থানে বসবাস শুরু করে। প্রথমত ভ্রাতৃপ্রতিম ইহুদিদের প্রতি মুসলমানদের কোন অভিযোগ ছিলনা। বরং বিভিন্নভাবে তাদের ফিলিস্থিনিরা সহযোগিতা করতে থাকে। ইহুদিরা মুসলমানদের অর্থলগ্নি ভূমি ক্রয় শুরু করে। বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারি ইহুদিরা ভিতরে ভিতরে মুসলমানদের ফিলিস্থান এবং তদ্সংলগ্ন এলাকা থেকে বহিষ্কার করার জন্য মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে। যুক্তরাষ্ট্র বৃটেন তাদের বিশেষ সহযোগিতা করে। হিব্রæ ভাষাকে জাতীয় ভাষা করার জন্য তারা স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ইহুদি অভিবাসী দ্রæত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমেরিকা এবং বৃটেনের সহযোগিতায় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ৭ লক্ষ ফিলিস্থিনিকে তাদের নিজস্ব আবাস ভূমি থেকে বিতাড়িত করে। ইহুদি মিলিশিয়ারা দেড় লক্ষাধিক ফিলিস্থিনিকে গুম ও হত্যা করে। তখন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পেট্রোলিয়াম খনির আবিষ্কার শুরু হয়। জাতিসংঘের ম্যানডেটের মাধ্যমে ফিলিস্থানকে ভাগ করে দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও মুসলমানরা তা মেনে নেননি। ১৯৬৭ সালে আরব ইসরাইল যুদ্ধে আরব বহুজাতিক বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলে আরো এলাকা ইসরাইল দখল করে নেয়। আরবদের তেলের খনির নিয়ন্ত্রন এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী গন্ডগোল বাধিঁয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বৃটেন বিভিন্নভাবে ইসরাইলকে বিশেষভাবে সাহায্য করে। ১৯৭৩ সালে ইসরাইলের সাথে মিসর সিরিয়া জর্ডান এবং ফিলিস্থিনের বহুজাতিক বাহিনী আবারও শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। আজ ৭৬ বছরের ইতিহাসে ফিলিস্থিনিরা নিজ ভূমিতে উদ্বাস্তুর মত। স্থায়ী রাষ্ট্র সার্বভৌমত্ব স্বাধীনতা কিছুই তাদের নেই। বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘের হঠকারি সিদ্ধান্ত ফ্রান্স বৃটেন আমেরিকার ভেটো প্রয়োগ ও ইসরাইল প্রীতি দিন দিন অবস্থার অবনতি ঘটায়। ২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবরে ইসরাইলে হামাসের হামলা ক্ষোভের বহিঃ প্রকাশ। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ছাড়া কোন দেশই সরাসরি ফিলিস্থিনের পক্ষে কথা বলেনা। তুর্কীরা ইসরাইলের সাথে বাণিজ্যিক সর্ম্পকসহ অন্যান্য সমস্ত সর্ম্পক স্থগিত করেছে। আরবের রাজতান্ত্রিক দেশগুলো ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আমেরিকা কিংবা ইসরাইলের বিপক্ষে কথা বলেনা। ফিলিস্থিনিদের স্বাধীনতার জন্য শিয়া অধ্যূষিত ইরান ইসরাইলকে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য লেবাননের হিজবুল্লাহ ইয়েমেনের হুতি এবং ইরাকের ইসরাইল বিরোধীদের বিভিন্নভাবে মদদ দিচ্ছে। অন্যদিকে ফিলিস্থানের হামাস এবং সমমনা সংঘঠনগুলো কাঁেধ কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছে। প্রায় ১০ মাস ব্যাপী যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। যা ছিল ইসরাইলের জন্য কলপ্নাতীত। সিরিয়ায় ইরানের কনস্যূলেটে ইসরাইলের বিমান হামলায় ১১ জন ইরানী সামরিক কর্মকর্তা নিহত হলে কয়েকদিন পর ইরান ইসরাইলে শত শত ক্রুজ, ব্যালেস্টিক মিসাইল ও আতœঘাতী ড্রোন দিয়ে পালটা প্রতিশোধ গ্রহন করে। ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে ইরান তার সামরিক অবস্থান জানান দেয়। হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মৃত্যু হলেও ইরানের আর্ন্তজাতিক নীতিতে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। ১৯৭৯ সালে ইরানের রেজা শাহ পাহলভীর পতনের পর ইসলামী শাসন কায়েম হয়। তখন থেকে ইরান যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অন্যান্য মিত্র দেশ কর্তৃক বাণিজ্যিক অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়। ইরানকে ধ্বংস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইরান ইরাক যুদ্ধ বাধিঁয়ে দেয়। পৃথিবীর কুখ্যাত ইসরাইলি গোয়েন্দা ‘মোসাদ’ তখন থেকে ইরানের ধর্মীয় নেতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সামরিক কর্মকর্তা এবং পরমানু বিজ্ঞানীদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। কিছু দিন আগেও ফিলিস্থানের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়ার ৩ সন্তান এবং ৪ নাতিকে বিমান হামলায় হত্যা করা হয়। ইসরাইলের আয়তন ২০হাজার বর্গকিলোমিটারের একটু বেশি এবং জনসংখ্যা ৯৮ লক্ষ। কুয়েত কাতার বাহরাইন লেবানন ছাড়া ইসরাইলের আশেপাশের দেশগুলো আয়তন ও জনসংখ্যায় অনেক বড়। যা ইরানের ১টি পুলিশ স্টেশনের আয়তনের সমান। অস্ত্র ও প্রযুক্তিতে ইসরাইলিরা অনেক এগিয়ে। বাড়ি গাড়ি নারীতে মত্ত আরব রাজতান্ত্রিক দেশগুলো ক্ষমতা হারানোর ভয়ে কোন প্রতিবাদ করেনা। ইসরাইলের সেনাবাহিনী (আইডিএফ) ফিলিস্থানের নতুন ভূমি দখল করে ইহুদিদের বসবাসের স্থান করে দিচেছ। তারা জেরুজালেমকে রাজধানী করে বহু আগেই বহু পয়গম্বরের স্মৃতি বিজড়িত হেবরন দখল করে নেয়। পবিত্র ‘আল আকসা’নিয়ে সদা গন্ডগোল লেগেই আছে। ইরান ইসরাইল হামলা পালটা হামলার মধ্য দিয়ে ফিলিস্থানকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। যা তৃতীয় মহাযুদ্ধের রুপ নেবে। যাতে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে। ইরান তুর্কীজোটে আরবরা যোগদান করলে ইসরাইল ১সপ্তাহ টিকবে না। ইসরাইলিরা পরাজয়ের শেষ মুহুর্তে ১৯৬৫ সালে সক্ষম হওয়া পারমানবিক বোমা ব্যবহার করতে পারে। নিজ ভুমিতে উদ্বাস্তু হওয়া অধিকার বঞ্চিত ফিলিস্থিনিরা অতি সহজে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পেতে পারে। ইরানের সাথে ইসরাইলের কোন স্থল সীমান্ত নেই। আকাশ পথের দুরত্ব ২হাজার কিলোমিটারের অধিক। সর্বাতœক যুদ্ধ শুরু হলে আকাশ ও জল পথেই হবে। সেই ক্ষেত্রে দুর পাল্লার মিসাইল আতœঘাতী ড্রোন বিমান হামলা হবে। ইরানের বিমান শক্তি কিছুটা দুর্বল হওয়ায় ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধে উন্নতমানের ড্রোনের বিনিময়ে ইরান রাশিয়া থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘সুখই- ৩৫’ বিমান এবং ‘এস-৪০০’ আকাশ প্রতিরক্ষা লাভ করে। ইরান ইসরাইলের যুদ্ধ সক্ষমতা সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। ইসরাইল স্বীকার না করলেও ১৯৬৫ সালেই পরমানু বোমের মালিক হয়। এত দিনে ইরানও ৯০% ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধি করণের মাধ্যমে পারমানবিক বোমা তৈরি করে ফেলেছে। কাজেই অস্তিত্ব বিপন্ন্ হলে উভয় পক্ষ তা ব্যবহার করবে। যা বিশ্ব জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইরান প্রক্্ির ওয়ারের মাধ্যমে হিজবুল্লাহ হুতি হামাস এবং অন্যান্য সমমনা গোষ্ঠির মাধ্যমে ইসরাইলের শক্তি ক্ষয় করছে। এ নাজুক অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ৮শত মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ইসরাইল ও ইউক্রেনকে দিচ্ছে। আমাদের নিধিরাম সর্দার দাদাদের আদানী গ্রæপ বড় ধরণের অস্ত্র রফতানী চুক্তি করেছে এবং দাদাদের ৭০ হাজার শ্রমিক জরুরী ভিত্তিতে ইসরাইলে নিয়োগ হচ্ছে। ‘র’ বিভিন্নভাবে ‘মোসাদ’কে সাহায্য করছে।‘মোসাদ’ এর জারজ সন্তান ‘র’। যার উদ্দেশ্য মুসলমান নিধন করা। পশ্চিমা অনেক মিত্র দেশ ইসরাইলের বর্বরতা নৃশংসতা এবং মানবধিকার লঙ্ঘনে অতিষ্ঠ হয়ে ফিলিস্থানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ কয়েক মাসের মধ্যে আয়ারল্যান্ড নরওয়ে ¯েপন মালটা ও ¯েøাবেনিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আরবদের মধ্যে ইসরাইল ফাটল ও অনৈক্য সৃষ্টি করে রেখেছে। হযরত এয়াকুব (আঃ) এর কুনিয়াত নাম ইসরাইল। বনি ইসরাইলের ইহুদা নামক এক শক্তিশালী পুরুষ ছিল। বিশ্বাসঘাতকতা ষড়যন্ত্র হঠকারিতা কৃতঘœতা এবং ধূর্ততায় সে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা এ বংশের বহু পয়গম্বরকে হত্যা করেছে । আল্লাহুর অভিসম্পাত প্রাপ্ত বনি ইসরাইলিরা যুগে যুগে বিভিন্ন দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। হাজার বছরের ইতিহাসে তারা কোথাও ৮০ বছরের অধিক রাজত্ব করতে পারেনি। সেই হিসেবে ইসরাইল রাষ্ট্রের আয়ু ৩/৪ বছরের অধিক নয়। প্রয়াত জার্মানীর চ্যান্সলর এডলফ হিটলার ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করে বলেছিল, ‘পৃথিবীতে আরো কিছু ইহুদিকে আমি জীবিত রেখেছি । যাতে পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে তাদের চরিত্র কত জঘন্য’। অনেক সমর বিশেষজ্ঞ মনে করেন,ফিলিস্থিনিদের প্রতি ইসরাইলের বর্বরতা নৃশংসতা ও বীভৎসতা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নাৎসী বাহিনীকেও হার মেনেছে। ভালকানের ‘কসাই’ নামে খ্যাত ¯øাবোদান মিলোসেবিচকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তুলনা করা হয়েছে। দি হেগে অবস্থিত আর্ন্তজাতিক আদালত ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীকে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য গ্রেফতারের পরোয়ানা জারি করতে যাচ্ছে। পরিশেষে বলা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া নামে খ্যাত অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্রটির ভৌগলিক পরিবর্তন অথবা পতন অত্যাসন্ন। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বহু দেশ ইসরাইলকে স্বীকৃতিই দেয়নি। ফিলিস্থিনিরা নিজ ভূমিতে পরবাসীর মত। তাদের আবাস ভূমি একদিন ফিরে পাবেই। মিথ্যার আস্ফালন ক্ষনস্থায়ী। সত্য চির ভাস্বর সমুজ্জ্বল। শুধু ইরান তুরস্ককে সামনে রেখে মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হলে ফিলিস্থিনিরা পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র রুপে আর্বিভূত হবে।
লেখকঃ শিক্ষক, ফুলগাঁও ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, লাকসাম কুমিল্লা