শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক

বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক

মো. খসরু চৌধুরী॥ ১৫ই আগস্ট ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন। বাঙালির হৃদয় ভাঙা বেদনার দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যিনি তার সারাটি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাঙালির মুক্তির জন্য, বাঙালির স্বাধিকারের জন্য।

ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এ হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, নবপরিণীতা পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য, বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদসহ অনেককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর ২ কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট খুনিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে দীর্ঘ ২১ বছর বাঙালি জাতি বিচারহীনতার কলঙ্কের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে নিয়মতান্ত্রিক বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ২০১০ সালে ঘাতকদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করে।

এ হত্যাকান্ডের পেছনে ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের এক গভীর ষড়যন্ত্র। ওই কালরাত থেকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি জাতির ঘাড়ে চেপে আছে। ইতিহাসের চাকা পেছনে ঘোরানোর চেষ্টাও চলে। স্বাধিকার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ফলে বাঙালি জাতি, বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের শত্রুা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে এ দেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা পরিবর্তনের যে কালো অধ্যায়ের সূচনা হয় তার পরিণতিতে জাতীয় রাজনীতিতে বারবার বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভেদ নীতিকে কবর দিয়েছিল। তা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াস চলে ১৫ই আগস্টের পর থেকে।

বিবেক বিক্রেতা খুনিদের সে অপচেষ্টা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু নেই কিন্তু তার অপরাজেয় আদর্শ টিকে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং খুনিদের ছয়জনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনিদের বিদেশ থেকে আইনি পথে দেশে এনে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টাও চলছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির হৃদয় থেকে তার আদর্শ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলেছিল।

সদ্যস্বাধীন দেশটিতে তখন চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল শুধুই ধ্বংসস্তূপ, পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতার ছাপ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য। ছিল না দক্ষ প্রশাসন। এরই মধ্যে পাকিস্তান কারাগারের ফাঁসির মঞ্চ থেকে রক্ষা পেয়ে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বাংলাদেশে। শুরু করেছিলেন দেশ গঠনের নতুন সংগ্রাম। মাত্র সাড়ে তিন বছরে পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করে দেশকে তিনি নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক তখনই হায়েনারা রাতের অন্ধকারে এ হত্যাকান্ড ঘটায়। বাহ্যত দলছুট কিছু সেনা সদস্যকে কাজে লাগালেও পেছনে ছিল অনেক বড় নীলনকশা। ব্রিটিশ সাংবাদিক মাসকারেনহাসসহ অনেকেই তুলে ধরেছেন সেই ষড়যন্ত্রের অনেক অজানা কথা। তুলে ধরেছেন কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কবে, কখন ঘাতক রশীদ বৈঠক করেছিলেন সেসব তথ্য। খন্দকার মোশতাক ও একটি প্রভাবশালী দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত কিভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়েছিলেন; অনেক কিছুই স্পষ্ট হয় পরবর্তী ঘটনামালা থেকে। রাষ্ট্রদূত বানিয়ে ঘাতকদের পুরস্কৃত করা, ইনডেমনিটির ঘোষণা দিয়ে খুনিদের বিচার রোধের অপচেষ্টা, স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করা, একাত্তরের ঘাতক আব্দুল আলীমসহ রাজাকার-আলবদরদের মন্ত্রী করা, গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা-এমন অনেক ঘটনাই প্রমাণ করে পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রে কারা যুক্ত ছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করলে প্রচলিত আইনে হত্যাকান্ডের বিচার শুরু হয়। বিচারিক প্রক্রিয়ায়ও উঠে আসে ষড়যন্ত্রের নানা দিক। বিচারের রায় অনুযায়ী কয়েকজন খুনির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। কিছু খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করার মাধ্যমে জাতিকে সম্পূর্ণরূপে কলঙ্কমুক্ত করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক। তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের পরম আত্মীয়, শত বছরের ঘোর নিশীথিনীর তিমির বিদারী অরুণ, ইতিহাসের বিস্ময়কর নেতৃত্বের কালজয়ী ¯্রষ্টা, বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা। বাঙালি জাতির পিতা।

বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে চেতনা অবিনশ্বর। বাঙালি জাতির অস্থিমজ্জায় মিশে আছেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিবাদর্শে শানিত বাংলার আকাশ-বাতাস জল-সমতল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিনাশী চেতনা ও আদর্শ চির প্রবহমান থাকবে।

জাতির পিতা চেয়েছিলেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে জয় করে বিশ্বসভায় একটি মর্যাদাবান ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল।

স্বাধীনতার অর্জনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র এখনো অব্যাহত আছে। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ খোলা জরুরি। একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় ‘জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী এবং মদদদাতাদের’ চিহ্নিত করে বিচারের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ‘কমিশন’ গঠন করার দাবিও এখন প্রাসঙ্গিক। দ্রুত সেই কমিশন গঠনের মাধ্যমে আইনসিদ্ধভাবে জাতির সামনে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা হোক।

লেখক : রাজনীতিক

Share This