শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বদলে যাচ্ছে গ্রাম

বদলে যাচ্ছে গ্রাম

            হারুন অর রশিদ \ শহর ছাড়িয়ে খানিকটা ভেতরে গেলে এখন আর গ্রামীণ ছমছমে ভাবের দেখা মেলে না। চারপাশে স¤প্রসারিত হচ্ছে নগর। কমছে গ্রাম, ফসলের মাঠ, পদ্মপুকুর। বাংলাদেশের চিরায়ত গ্রামগুলো সবার অলক্ষ্যে বদলে যাচ্ছে পালাবদলের প্রহরে প্রহরে। ছবির মতো সুন্দর, সাজানো, প্রাকৃতিক সবুজে-শ্যামলে ভরপুর ‘আমাদের গ্রামখানি’ পাওয়া তাই ক্রমে ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে।

            হেমন্তের উজ্জ্বল সকালে শহরের আশেপাশের গ্রামগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এই চিত্র। বেশকিছু দালান-কোঠা, অপরিকল্পিত ব্যক্তি মালিকানাধীন স্থাপনা। পাশেই শহীদ স্মৃতিসৌধ। জায়গাটিকে গ্রাম নয়; গ্রাম- শহরের মিশেল বলে চিহ্নিত করা চলে।

            পাকা রাস্তার পাশ দিয়ে যেতে যেতে দু’পাশে সঙ্কুচিত সবুজের দেখা মেলে। ক্রমেই কমছে ফসলের মাঠও। তা দখল করে তৈরি হয়েছে অনেক ইটের ভাটা আর নতুন নতুন বাড়ী। কমছে গাছ-পালা, পরিবেশেরও বারোটা বাজছে। ‘এলাকার অনেকেই বিদেশে থাকেন, কাঁচা টাকায় পাকা বাড়ি বানাচ্ছেন তারা। ফসলের ক্ষেত-বাগান কিনে বাসা-বাড়ি, মার্কেট তৈরি হচ্ছে। এজন্যই ইটের ভাটার এতো চাহিদা। জায়গার দামও হু হু করে বাড়ছে’।

            ছোট ছোট গ্রাম্য বাজার এলাকায়ও এখন অনেক মার্কেট। আশেপাশে টিনের বাড়ির চেয়ে পাকা দালানই বেশি। গ্রামের হাট-বাজার বলতে যে উন্মুক্ত-খোলামেলা কেনা-বেচার পসরা, সেটিও আর নেই।

            কয়েক মাইল পথ পার হয়েও তিন-চারটির বেশি পুকুরের দেখা মেলেনি। গ্রামের ভেতরের দিকে কিছু পুকুর থাকলেও বড় রাস্তার কাছাকাছি পুকুর ভরাট করে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে ভেতরের দিকটাতে গ্রামীণ পরিবেশ কিছুটা বিদ্যমান এখনো। কোনো কোনো গ্রামে টিন-খড়ের ঘরই বেশি। কলাপাতা শুকিয়ে বাঁশের পাল­ায় পর্দার মতো টাঙ্গিয়ে রক্ষা করা হচ্ছে বাড়ির আব্রæ। উদাম ছেলে-মেয়ে আর খালি শরীরের মানুষেরা দিব্যি গ্রামীণ পরিবেশের অঙ্গ হয়ে রয়েছেন। আর আছে চারপাশ ঘিরে থাকা দারিদ্র্যের অন্ধকার, অপুষ্টির ছাপ।

            ‘গ্রামের মানুষ মাছ ধরে না, বাজার থেকেই কিনে খায়’- সড়কের পাশের এক নিভৃত গ্রামে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা চলে না। গ্রামের এ রূপান্তরে সুষ্ঠু পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। দালান-কোঠা, নানা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পাকা রাস্তার আশেপাশে। সেখানে ধনবানরা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো নানা স্থাপনা গড়ছে অপরিকল্পিতভাবে। গ্রামীণ কৃষিজমি প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে হাতবদল হয়ে যাচ্ছে ফড়িয়া, দালাল বা উঠতি ধনী মানুষের হাতে। পরিবর্তিত হচ্ছে পেশাও। কৃষি ও কৃষিভিত্তিক পেশা ছেড়ে লাভজনক নানা পেশায় বা ব্যবসায় চলে যাচ্ছে অনেকেই। তবে গ্রামকেই আধুনিক ও উন্নত করে গড়ার পক্ষে গ্রামের শিক্ষিত লোকজন। গ্রামকে গ্রাস করে শহর বানানোর নানা ক্ষতি নিয়ে আশঙ্কা তাদের।

            বাস্তবতা হলো- অদূর ভবিষ্যতে গ্রাম বলে কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। সবাই আধুনিক হয়ে যাচ্ছেন। গ্রামীণ পোষাক, খাবার, পেশার কি হবে- সে ভাবনা কারো নেই।

 ‘লাভের জন্য সবাই বড় রাস্তা বা বাজারের দিকে চলে আসছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্য সুবিধাও এদিকেই বাড়ছে। ভেতরের গ্রামগুলো কিন্তু এখনো অন্ধকার। এভাবে অবহেলিত হলে গ্রাম টিকবে কি করে?’

            উদাসী মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় আমাদের গ্রামখানি’ মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে হারিয়েই যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে বাস্তবের জায়গা ছেড়ে স্মৃতির আঙিনায়।

Share This