শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বাজারের অস্বাস্থ্যকর ইফতারি বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

বাজারের অস্বাস্থ্যকর ইফতারি বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

            ষ্টাফ রিপোর্টার\ বাজারের অস্বাস্থ্যকর ইফতারি বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুনি, চপ, ছোলা, জিলাপি, নিমকপরা, পাকোড়া- সব খাবারই ডুবো তেলে ভাজা। এছাড়া মুড়িতে ইউরিয়া, জিলাপি-বুন্দিয়ায় ব্যবহৃত হচ্ছে কাপড়ের রং। অথচ এসব খাবার ছাড়া যেন ইফতারির ষোলকলা পূর্ণ হয় না। রমজান মাসে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই পাড়া-মহল্লায় রাস্তার পাশে বসে এসব মৌসুমি ইফতারির দোকান।

            বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্টের সামনের অংশে থরে থরে সাজানো থাকে এসব লোভনীয় ইফতারি। আর সারা দিনে না খেয়ে থাকা রোজাদার ক্রেতারা একটু মুখরোচক ঝাল ঝাল মুচমুচে খাবার খেতে দেদার কিনে নেন এসব খাবার। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, রং দিয়ে, ডুবো তেলে, পোড়া তেলে ভাজা এসব খাবার শরীরের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্যানসার, হৃদরোগ, ফ্যাটিলিভারসহ নানা স্বাস্থ্যঝুঁকি।

কিছু হোটেল-রেস্টুরেন্টের ইফতার প্ল­াস্টিক দিয়ে ঢেকে রাখা হলেও বেশির ভাগ ইফতারি বিক্রয় হচ্ছে খোলা অবস্থায়। অনেকে আবার কেরোসিনের চুলা জ্বালিয়ে ভাজছে জিলাপি, পাকোড়াসহ ইফতারির বিভিন্ন আইটেম।

            ইফতার কিনতে আসা নূরে আলম বলেন, আমরা তো মেসে থাকি, তাই এসব বাইরের খাবার আমাদের একমাত্র ভরসা। স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে জেনেও এসব খাবার আমরা কিনে খাই। আরেক জন ক্রেতা রাসেল বলেন, ওনারা তো বাধ্য হয়ে খান, কিন্তু আমার বাসার বাচ্চারা বাসারটা খাবে না, খাবে বাজারের কেনাটা। এতে পয়সাও খরচ হচ্ছে বেশি এবং স্বাস্থ্যেরও বারোটা বাজছে, কিন্তু বাচ্চাদের মানাতে পারছি না। তিনি বলেন, আমরা আসলে সচেতন মানুষ নই। এদিকে গৃহিণী আয়েশা আমিন বলেন, বাঙালির খাবারে ভাজা-পোড়া খাবার এমনভাবে মিশে গেছে যে, পিঁয়াজু, বেগুনি, আলুনি ছাড়া যেন ইফতার পূর্ণতা পায় না। যতই স্বাস্থ্যকর অন্য খাবার ইফতারিতে রাখি না কেন, ওই সব ছাড়া যেন ইফতার অপূর্ণ থাকে।

            পুষ্টিবিদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে মুড়ির। সেই মুড়িকে সাদা করতে ব্যবহৃত হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। মুড়ি বড় বড় দানায় পরিণত করতে ব্যবহার হয় ইউরিয়া সার। মুড়িতে মেশানো এই ক্ষতিকর উপাদান পেটে গেলে আলসার, মানব দেহে রক্তের শ্বেতকণিকা, হিমোগেø­াবিনের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। জিলাপি দীর্ঘক্ষণ মুচমুচে রাখতে তেলের সঙ্গে মবিল মেশানো হচ্ছে। ভাজাপোড়ায় ব্যবহৃত তেল কড়াই থেকে তিন-চার দিনেও ফেলা হচ্ছে না। এসব দিয়ে তৈরি খাবার পেটের পীড়া, কিডনি ও যকৃত সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কেমিক্যাল রং। কম খরচে বেশি লাভের আশায় একশ্রেণির ইফতার বিক্রেতা ফুড কালারের পরিবর্তে ব্যবহার করে কাপড়ে ব্যবহৃত রং।

            জানা যায়, এক কেজি টেক্সটাইল কালারের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ টাকা। সেখানে এক কেজি ফুড কালারের মূল্য প্রায় ১০ হাজার টাকা। খাদ্যে মেশানো কাপড়ের রং স্বল্প সময়ে কিডনি ও লিভারে আক্রান্ত করে, দীর্ঘমেয়াদে মানবদেহে ক্যানসারের মতো রোগ সৃষ্টি করে। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে ভেজাল চিনি। এর রাসায়নিক নাম সোডিয়াম সাইকামেট। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যকে অধিকতর মিষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্যাকারিন, সুকরালেস ইত্যাদি। জিলাপিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল সামগ্রীর পাশাপাশি বাসন্তী রং ব্যবহার করা হয়। ফলে সাধারণ জিলাপির চেয়ে এসব জিলাপি বেশি উজ্জ্বল দেখা যায়। হালিমে মাংসের দেখা মেলে না, তবে আগের দিনের অবিক্রীত ডাল ও মাংসের উচ্ছিষ্ট থাকে ঠিকই।

            চিকিৎসকরা বলছেন, সারা দিন রোজা রেখে অস্বাস্থ্যকর তেলে ভাজা ইফতারি হৃদরোগ-স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। একই তেল দিনের পর দিন ব্যবহার করে তৈরি খাবার নিয়মিত গ্রহণে ফ্যাটিলিভার থেকে শুরু করে লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তারা বলছেন, ধর্মীয়ভাবে এ মাসে সংযমের কথা বলা হলেও এ মাসেই অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা হচ্ছে। আর ইফতারির নামে যা খাওয়া হচ্ছে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমাদের দেশে ইফতার মানেই ভাজাপোড়া, এসব তৈলাক্ত জিনিস বেশি খাওয়া ক্ষতিকর। বিশেষ করে হার্টের রোগী, ডায়াবেটিসের রোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর।

            নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩-এর ২ ধারা অনুযায়ী ‘নিরাপদ খাদ্য’ বলতে প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্য বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এই আইনগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ না হওয়ার কারণে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্য ভেজাল মিশিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

            জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, রমজান মাসে শরবত মানুষের খুব প্রিয় পানীয়। বাজারে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শরবতগুলোতে কী রং মেশানো হয়, তা আপনারা জানেন। এসব রং বেশির ভাগই খাবারযোগ্য রং নয়। এসব রং মানুষের শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়ায়, চোখের সমস্যা বাড়ায় এবং শরীরের ত্বকের ক্ষতি করে। এছাড়া এই রং কিডনি ড্যামেজ করে ফেলে। খাবারকে মজাদার করার জন্য যে টেস্টিং সল্ট ব্যবহার করা হয় এটাও নানাভাবে মানুষের জীনকে বাধাগ্রস্ত করছে। তিনি আরো বলেন, রাস্তার পাশে বসে যে ইফতারি তৈরি করছে ক্রমাগত বায়ুদূষণের কারণে এই খাবারগুলোতে ধূলাবালি পড়ছে এবং খাবার দূষিত হচ্ছে। যারা এই খাবারগুলো তৈরি করছে তারা হাত পরিষ্কার করছে না, হাতে গø­াভস পরছে না। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে খাদ্যে ভেজালের কারণে।

Share This

COMMENTS