বিএনপির দাবি নির্বাচন জামায়াত চায় সংস্কার
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ শেষে দুই যুগের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থানের চিত্র ফুটে উঠেছে। বিএনপি দ্রুত কমিশন গঠন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও নির্বাচনের চেয়ে সংস্কারে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত।
উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে অন্যান্য দল ও সেনাবাহিনী আলোচনা করে এই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সরকার গঠনের পর গত ১২ই আগস্ট প্রথম দফায় এবং ৩১শে আগস্ট দ্বিতীয় দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ই অক্টোবর তৃতীয় দফায় দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারের পক্ষে তার সঙ্গে ছিলেন, উপদেষ্টা হাসান আরিফ ও আদিলুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
এদিন বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ সংলাপে অংশ নেয়।
প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে রাজধানীর হেয়ার রোডে তার সরকারি বাসভবন যমুনায় বিএনপিকে দিয়ে শুরু হয় সংলাপ। সংলাপ শেষে বেরিয়ে এসে মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপির মহাসচিব বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচন কমিশন কবে নির্বাচন করবে, সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। একই সঙ্গে বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন সংস্কার কমিশনে না যায়, সে কথাও বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে বলা হয়েছে বলে জানান মির্জা ফখরুল।
অন্যদিকে, সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের সামনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, এ সরকার দেশ শাসনের জন্য আসেনি, দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মাণের জন্য তারা এসেছে। তাদের কাজ হচ্ছে, গত তিনটি নির্বাচনে জাতি যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, তার একটা গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। এ জন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের সংস্কার করতেই হবে। কী কী মৌলিক বিষয়ে তারা সংস্কার করবেন, আমরা সে বিষয়ে কথা বলেছি।’ জামায়াত সংস্কারকে এক নম্বরে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানান আমির শফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘সংস্কারের টাইমলাইন কী হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা দুটি বিষয় দেশবাসীর কাছে চেয়েছি এবং সরকারের কাছে জানিয়েছি। একটা রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটা নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে। দুটি বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি।’
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শেষে ওই রাতেই রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে শফিকুল আলম বলেন, ‘এখনই আমরা টাইমটা বলতে পারছি না।’ তবে তিনি বলেন, ‘ছয়টি কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলবে, তাদের তিন মাসের টাইমলাইনের মধ্যে। এরপর তিন মাসের মধ্যে একটা করে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আবার উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এরপর সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ন্যূনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের টাইমলাইন।’
উল্লেখ্য, ৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বলেছিল বিএনপি; যদিও দ্রুতই দলটি সেই অবস্থান থেকে সরে আসে। তারা নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিতে অবস্থান স্পষ্ট করে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কয়েকটি দল শুরু থেকে সংস্কার কাজের ওপর গুরুত্ব দিতে থাকে। সব মিলিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে। জামায়াত ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে জোট গঠনের চেষ্টা করছে।
অন্যদিকে, বিএনপি বিভিন্ন ভয় পাচ্ছে, এমনকি দলটির সিনিয়র নেতারা বারবার মাইনাস টু ফর্মুলাকে স্মরণ করিয়ে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছেন। নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে দলটির নেতাদের বাদানুবাদে জড়াতে দেখা গেছে, যা রাজনীতিতে অস্থিরতা ছড়াতে পারে বলে অনেকের আশঙ্কা রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ শেষে নির্বাচন প্রশ্নে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এবং দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বিভক্তি ফুটে উঠেছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, ‘যারা মনে করবে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় আসবে, তারা দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাবে এবং যারা মনে করবে নির্বাচন হলে তাদের সরকার গঠনের সম্ভাবনা কম, তারা নির্বাচন দেরিতে হোক এমনটাই চাইবে। উভয়টাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামিক দলগুলোর দিক থেকে মনে হচ্ছে নির্বাচনের আগে তারা যত সময় পাবে, সেটা আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করবে। আর বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন আর সরকার গঠন এটুকু দূরত্বে তারা দাঁড়িয়ে আছে। সরকার চাইবে যত বেশি সময় নেওয়া যায়। তারা যে সংস্কার চাইছে, তার তো কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ইতিমধ্যে দেশের কিছু কিছু জায়গায় অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।’ Ref: thikana