শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিজয়গাথা একাত্তর

বিজয়গাথা একাত্তর

            রাশিদুল হাসান\  অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে আমরা বিজয়ের ৫২ বছর অতিক্রম করতে চলেছি। এ অর্ধ-শতাব্দীতে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি, আবার অনেক কিছু পাইনি। এর বিচারের ভার পাঠকের ওপরই ছেড়ে দেয়া হলো। বাঙালি জাতির ওপর বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ, বৈষম্য, মাতৃভূমির ইতিহাস এখনো আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে। পাকিস্তানের জন্ম লগ্ন থেকেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। বৈষম্যের মাত্রা অবসানের নিমিত্তে ১৯৬৬ সালের ৫ই ফেব্রæয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত আরটিসি সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তির সনদ হিসাবে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানের তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এতে ক্ষুব্ধ হন এবং ফলে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গণ গ্রেফতারের প্রতিবাদে এবং ছয় দফা দাবির সমর্থনে সমগ্র দেশ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। পান্তরে পাকিস্তানের শাসকরা এ ছয় দফাকে মনে করতেন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের ছদ্ম দলিল’। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে ১৯৬৯ সালের ২২শে ফেব্রæয়ারি প্রবল গণআন্দোলনের চাপে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হয়। জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, রুহুল কুদ্দুস সিএপি, স্টুয়ার্ড মুজিবর রহমান, ক্যাপ্টেন শওকত আলী, ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানসহ ৩৪ জন রাজবন্দিকে সম্মানের সঙ্গে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২৫শে মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

            পাকিস্তানের ইতিহাসে ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম ও শেষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমেদের বক্তব্য অনুযায়ী জাতীয় সংসদের ১৬২ আসনের জন্য মোট আবেদনপত্র পাওয়া যায় ৩৫৯টি (সূত্র : বিবিসি বাংলা নিউজ)। ওই জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পূর্বপাকিস্তানে ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি+৭টি মহিলা আসন=১৬৭টি আসন লাভ করে। পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮ আসনের মধ্যে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি মহিলা আসনসহ মোট ৮৮টি আসন পায়। ১৭ই ডিসেম্বর, পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার এবং প্রাদেশিক পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় এম মনসুর আলীকে পূর্বপাকিস্তানের পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার নির্বাচিত করা হয়। ৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের ভাবি প্রধান মন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী পূর্বপাকিস্তানের ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বিবেচিত হতে থাকেন।

            ষড়যন্ত্র চলতে থাকার একপর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুর ১.১৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানে ৩ মার্চ আহুত জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে চলমানরত পাকিস্তান ও এমসিসি ক্রিকেট খেলা অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার দর্শক, ছাত্র, জনতা রাস্তায় নেমে আসে এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৩রা মার্চ পল্টনের মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। ওই সভায় আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের আহ্বান জানান এবং জনগণের প্রতি খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

            ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ পড়ন্ত বিকালে তদানিন্তন রেসকোর্স ময়দান জনতার মহাসমুদ্রে স্বাধীনতার আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দৃপ্ত পায়ে মঞ্চে উঠলেন এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতাখানা পাঠ করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পরিচালিত হয়। ঐতিহাসিক ভাষণের পর, ঢাকা তথা সমগ্র পূর্বপাকিস্তান জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত হয়। এ সময় পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের হেলিকপ্টার আকাশে টহল দিতে ছিল। খ্যাতিমান আর্ন্তজাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজইউক ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল সংখ্যার প্রচ্ছদ স্টোরিতে বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে অভিহিত করেন।

            ঢাকায় পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির লিডার ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে ঢাকা ত্যাগ করেন। জেনারেল রাওফরমান আলীর নেতৃত্বে ঢাকায় এবং জেনারেল খাদিমের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনাসহ মোট ১০টি শহরে ২৫শে মার্চ রাত ১১.৩০ মিনিটে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করা হয়। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ইপিআর হেডকোয়াটার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, তদানিন্তন ইকবাল হল মূল টার্গেটে পরিণত হয়। হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালি ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, যা ছিল বিশ্বের ইতিহাসে এক বর্বরোচিত গণহত্যা। ২৬শে মার্চ ০০:২০ মিনিটে পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির লিডার আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন- ‘ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন…’। পাকিস্তান আইএসপিআর এর পিআরও মেজর সালিক সিদ্দিকের ওয়্যারলেসে ঘোষণাটি শুনতে পাওয়া যায়। রাত ১:৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের নিজ বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে ওয়্যারলেসে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর জানায়-‘বিগ বার্ড ইন দ্যা কেজ, অন্যান্য পাখিরা নীড়ে নেই, ওভার’ (সালিক সিদ্দিক, উইটনেস টু স্যারেন্ডার)। অতঃপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডির লয়ালপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিংকসই প্রথম ২৫শে মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার খবরটি ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক ম্যাসকা রেনহাস ১৯৭১ সালের ১৫ই জুন ঢাকাসহ সমগ্র দেশের বর্বোরচিত গণহত্যার ভয়াবহ চিত্র ‘সানডে টাইমস’ এ তুলে ধরেন। ওই হৃদয়বিদারক রিপোর্টটি পাশ্চত্য তথা সমগ্র বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয় এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। উল্লেখিত রিপোর্টটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয়, তার ফলে ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

            ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে বিবেচিত হয়। ১০ই এপ্রিল এক বিশেষ অধিবেশনে ১৯৭০ সালের নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের ১৬৭ সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত ২৯৮ সদস্যের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। ওই অধিবেশনে ২৬শে মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করা হয়, যা অন্তর্র্বতীকালীন সংবিধান হিসাবে গণ্য করা হলো। ওই সংবিধান ৪০৪ জন গণপরিষদ সদস্য কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়, যার মূলভিত্তি হচ্ছে স্যাম্য, সামাজিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল গণপরিষদের বিশেষ অধিবেশনে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অপর্ণ করা হয়। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলার আ¤্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে উল্লেখিত সরকারের মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ওই ‘মুজিবনগর সরকার’ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রথম গণতান্ত্রিক ও আইনানুগ সরকার। এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং এমএ রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ দেয়া হয়। মুজিবনগর সরকারের মেয়াদকাল ছিল ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি।

            মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন সফর করেন। চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তান মধ্যস্থতা করে। ফলে ১৯৭১ সালের ৯ই আগস্ট ২০ বছর মেয়াদি ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা সহায়ক শক্তি হিসাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান সুসংহত করে। হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েতের বন্ধুত্ব এ দু’টি ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষা কবচ। পর্বত প্রমাণ কফিনের নিচে অখন্ড পাকিস্তানের কবর রচিত হয়। ৩০ লাখ শহিদের তাজা তপ্ত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা উপাখ্যানের পশ্চাতে রয়েছে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বলিষ্ঠ নের্তৃত্ব।

            দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের তাজা তপ্ত রক্ত এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান একে খন্দকারের উপস্থিতিতে বিকাল ৪:৩১ মিনিটে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। ওই দলিলে জেনারেল অরোরা প্রতিস্বাক্ষর করেন। বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় চার নেতা পরিষদ

Share This