শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিবাদ-বিসংবাদ নিরসনে শান্তিপূর্ণ সমঝোতা প্রসঙ্গ

            পৃথিবীতে বহু রকমের মতভেদ হতে পারে। নানা বিষয়ে নানা প্রকারের বিবাদ-বিসংবাদ তৈরি হতে পারে। সকল বিবাদ এক প্রকারের হবে এটা সম্ভব নয়। অনেক রকমের হবে। বিবাদের মূলে যে মতভেদ-মতভিন্নতা তা বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। কিছু বিবাদ-বিসংবাদ এমন হয় যেখানে দু’টো মতই সঠিক। দু’টো মতের পক্ষেই শরীয়তের দলিল রয়েছে। যে রকম আমাদের আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে তাঁদের একাধিক মত সামনে এসেছে।

            এ জাতীয় ক্ষেত্রে যেহেতু উভয় মতের পক্ষে কুরআন ও সুন্নাহর দলিল রয়েছে সেহেতু উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, তাদের দলিলসম্মত সিদ্ধান্তগুলো সবগুলোই সহীহ। তো এ জাতীয় বিষয় নিয়ে যদি বিবাদ-বিসংবাদ তৈরি হয় তাহলে তা কুরআন ও সুন্নাহর সামনে পেশ করা হলে কুরআন-সুন্নাহর মাহির ব্যক্তিবর্গ বলে দিবেন, এখানে উভয় মত সঠিক। এখানে এক পক্ষ অপর পক্ষের মতকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং একে অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হও এবং যার জন্য যে মত অনুসরণ উপযোগী হয় সে সেই মতের অনুসরণ কর। ফলে এখানে একাধিক মত থাকবে, কিন্তু বিবাদ-বিসংবাদ থাকবে না।

            সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা, সুখ-সমৃদ্ধি, ঐক্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের নিদর্শনস্বরূপ মানুষের মধ্যে স্নেহ-মায়া-মমতা, শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি, ধৈর্য-সহনশীলতা, সততা, বিশ্বস্ততা, সংবেদনশীলতা প্রভৃতি সামাজিক গুণ অবশ্যই থাকা উচিত। সেখানে থাকতে পারে না কোনো প্রকার দ্ব›দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গোলমাল-হানাহানি, সংঘাত-সংঘর্ষ, ফিতনা-ফ্যাসাদ, সহিংসতা-উগ্রতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অনিষ্ট ও অকল্যাণের অশুভ লক্ষণ। মানবসমাজে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কার্যকলাপকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআনে নিষেধবাণী ঘোষিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর এতে তোমরা বিপর্যয় ঘটাবে না।’ (সূরা আল-আরাফ, আয়াত: ৫৬) কলহ-বিবাদ ও ফিতনা-ফ্যাসাদ সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্ব›দ্ব-কলহ মানুষের জীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা ঘটায়। মানবতার ঐক্য ও সংহতিতে ভাঙন সৃষ্টি করে সেখানে বিভেদ, অনৈক্য ও বিভক্তি নিয়ে আসে। ফিতনা-ফ্যাসাদের ফলে পরস্পরের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা ও হিং¯্রতা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সামান্য তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মারাত্মক ঝগড়া-বিবাদ ঘটে এবং তা বড় আকার বিশৃঙ্খলা ধারণ করে মানবসমাজে হত্যাকান্ডের ন্যায় পাপাচার সংঘটিত হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯১) ঝগড়া-বিবাদ, ফিতনা-ফ্যাসাদের কারণে সমাজে পরচর্চা, পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, ঠাট্টা-বিদ্রæপ, হিংসা-বিদ্বেষ, অপবাদ, মিথ্যা দোষারোপ প্রভৃতি নানা ধরনের নিন্দনীয় কর্মকান্ডের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এতে মানুষের সৎকর্ম নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণত পারস্পরিক গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ, দ্ব›দ্ব-কলহ, অশ্লীল ও অশালীন কথাবার্তার মাধ্যমে ফিতনা-ফ্যাসাদ শুরু হয়। এমতাবস্থায় মানুষ ইমানদার থাকা তো দূরের কথা পশুর চেয়েও নিম্নস্তরে নেমে যায়। তাই সমাজ থেকে এসব অসদাচরণ অবশ্যই বর্জন করা দরকার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করবে না, গুপ্তচরবৃত্তি করবে না, পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবে না, পরস্পরের সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষ করবে না, পরস্পরকে ঘৃণা করবে না এবং পরস্পরের ক্ষতি সাধন করার জন্য পেছনে লাগবে না। আর তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাবে।’ (বুখারি ও মুসলিম) পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা তখনই সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়, যখন উভয় পক্ষের মধ্যে সংলাপ বা সলাপরামর্শ, সত্য সন্ধান, বাস্তবতা অন্বেষণ ও তা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে সম্পন্ন হয়। লোকেরা যদি আলোচনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যায় এবং উভয় পক্ষ বা অন্তত এক পক্ষ একগুঁয়েমি ও অপর পক্ষের ওপর ক্ষমতার জোর প্রতিষ্ঠা করার ওপর অটল থাকে, তখন শত্রুতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এমতাবস্থায় সমাজ-জীবনে দুই দলের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হলে তা নিরসনে ইসলামের বিধান অনুসারে জনসাধারণ মীমাংসা করে দেবে। যদি একদল মীমাংসা করতে রাজি না হয় তাহলে সমাজের নেতৃস্থানীয় জনগণ ওই দলের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং মীমাংসা মেনে নিতে বাধ্য করবে এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে উভয় দলের মধ্যে সন্ধি ও শান্তিপূর্ণ সমঝোতা করে দিতে হবে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মুমিনদের দুই দল দ্ব›েদ্ব লিপ্ত হলে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেবে। অতঃপর তাদের একদল অপর দলকে আক্রমণ করলে তোমরা আক্রমণকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে। যদি তারা ফিরে আসে তবে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা করে দেবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ৯) ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের দাবিতে দুই বিবদমান ব্যক্তির কর্তব্য হলো তাদের ঝগড়া-বিবাদ নিরসন করা, কলহ মিটিয়ে ফেলা এবং সন্ধি-সমঝোতা সৃষ্টি করা। এ ক্ষেত্রে সুশীল সমাজেরও দায়িত্ব রয়েছে। বিনা কারণে তর্কবিতর্ক পাপ ও দুঃখ বয়ে আনে এবং মানুষের গোপন রহস্য বা দোষত্রুটি ফাঁস করে দেয়। ফিতনা-ফ্যাসাদের বিরুদ্ধাচরণ করে নবী করিম (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হবে না।’ (তিরমিজি) ইসলাম বিনা কারণে ঝগড়া-বিবাদের মতো ঘৃণ্যতর কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কোনো বান্দা যে পর্যন্ত ঝগড়া-বিবাদ বর্জন না করবে, সে পর্যন্ত তার ইমানের বাস্তব রূপের পরিপূর্ণতা বিধান করতে পারবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঝগড়া-বিবাদ পরিহারকারীদের সুসংবাদ দিয়ে বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তির জন্য বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি, বেহেশতের মধ্যভাগে একটি এবং বেহেশতের বাগানে একটি ঘর আমার জিম্মায় রয়েছে, যে এমনকি ন্যায়বাদী হওয়া সত্তে¡ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকে।’ ইসলাম ঝগড়া-বিবাদকে সবচেয়ে নিম্নস্তরের আমল বিনষ্টকারী বলে গণ্য করেছে। ধর্মপ্রাণ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো, ঝগড়া-বিবাদ যতই হোক, বিপদ-আপদে, শত্রু-মিত্র বাছ-বিচার না করে বিপদগ্রস্তের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়া। ঝগড়া-বিবাদকারীরা সমাজের লোকের কাছে অপছন্দনীয়।

            কলহ-বিবাদ সৃষ্টিকারীদের যেমন সাধারণ মানুষ ঘৃণা করে, তেমনি আল্লাহ তাআলাও তাকে অপছন্দ করেন। তাই বলা হয়েছে, ‘তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে না, নিশ্চয়ই আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৭৭) সমাজে পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহমর্মিতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার ফলে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও সহাবস্থানে মন থেকে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা ও হৃদয়হীনতার পাশবিক বৈশিষ্ট্য দূর হয়ে যায়। মানবসমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ব্যক্তি তার সম্মান ও মর্যাদা সংরক্ষণ করতে চায়, তার সর্বাবস্থায় ফিতনা-ফ্যাসাদ ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বেঁচে থাকা বাঞ্ছনীয়। সৌজন্যে: প্রথমআলো।

-ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।

Share This

COMMENTS