ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস ও তাঁর ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারির মধ্যে দূরত্ব কী কিছুটা ঘুচতে পারে!


ষ্টাফ রিপোর্টার\ বিগত পাঁচ বছরের টানাপোড়েন, রাগ-অভিমান আর গভীর বিভাজন যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের ভেতরে রেখে গেছে দগদগে ক্ষত। রাজা তৃতীয় চার্লস ও তাঁর ছোট ছেলে প্রিন্স হ্যারির মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা যেমন পরিবারকে আঘাত করেছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। তবে উত্তেজনার বরফ কিছুটা গলতে শুরু করেছে। ইঙ্গিত মিলেছে, বাবা-ছেলের মধ্যে এবার নতুন এক বোঝাপড়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে হয়তো!
উল্লেখ্য, আগামী ৮ই সেপ্টেম্বর সোমবার লন্ডনে ওয়েলচাইল্ড পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছেন প্রিন্স হ্যারি। অসুস্থ শিশু ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তা করা এই দাতব্য সংস্থার ১৭ বছর ধরে পৃষ্ঠপোষক তিনি। এর আগে গত এপ্রিলে তিনি নিরাপত্তাসংক্রান্ত আদালতের শুনানিতে অংশ নিতে যুক্তরাজ্য গিয়েছিলেন। সে সময় তাঁর বাবা রাজা তৃতীয় চার্লস রাষ্ট্রীয় সফরে ইতালি ছিলেন। তাই তখন কোনো সুযোগ ছিল না তাঁদের দেখা হওয়ার মতো।
তবে এবার পরিস্থিতি খানিকটা ভিন্ন। খুব বেশি না হলেও অবস্থাদৃষ্টে কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। তবে সবার দৃষ্টি- এবারকার এই সফরে কী তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা হবে?
প্রথমত, রাজা সে সময় যুক্তরাজ্যেই থাকবেন। তিনি স্কটল্যান্ডের বালমোরাল এস্টেটে থাকবেন। চাইলে হ্যারি সেখানেও যেতে পারেন। তবে ক্যানসারের চিকিৎসা ও দায়িত্ব পালনে রাজা নিয়মিত দক্ষিণে যাতায়াত করেন। এ কারণে এবার সরাসরি বাবা ও ছেলের দেখা হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ বিদ্যমান আছে।
প্রকাশ থাকে যে, সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৬ই ফেব্রæয়ারি বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন হ্যারি। সে সময় রাজা চার্লসের প্রথমবার অসুস্থতার খবর প্রকাশ্যে আসায় হ্যারি হিথরো বিমানবন্দরে নেমে সরাসরি কারেন্স হাউসে গিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে আধা ঘণ্টারও কম সময় কাটিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান তিনি।
এবার দূরত্ব কমার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে হ্যারি ও তাঁর স্ত্রী মেগানের নতুন জনসংযোগ দলের পদক্ষেপের কারণে। হ্যারি-মেগানের নতুন জনসংযোগ টিমের প্রধান লস অ্যাঞ্জেলেসের মেরেডিথ মেইন্স গত জুলাইয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্যে তাঁর প্রতিপক্ষ লিয়াম ম্যাগুয়ারের সঙ্গে বিবিসি নিউজসহ বেশ কয়েকটি দাতব্য সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন।
তবে সে সময় নজর কাড়ে অন্য একটি ঘটনা। লন্ডনের এক প্রাইভেট মেম্বারস ক্লাবে একজন আলোকচিত্রী তাঁদের ছবি তোলেন। সেখানে তাঁদের সঙ্গে রাজা চার্লসের যোগাযোগ সচিব টোবিন আন্দ্রেয়া ছিলেন। ছবিগুলো দ্য মেইলের রোববারের সংখ্যায় ‘দ্য সিক্রেট হ্যারি পিস সামিট’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে আলোকচিত্রী ঘটনাস্থলে কীভাবে উপস্থিত ছিলেন, তা এখনো রহস্য। তবে উভয় পক্ষই ছবির খবর ফাঁস করার কথা অস্বীকার করেছে। অবশ্য কয়েক বছর আগেও এ ধরনের বৈঠকের কথা অকল্পনীয় ছিল। এখন একসঙ্গে টেবিলে বসে নিজেদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা ইঙ্গিত দিচ্ছে, উভয়েই পরিস্থিতি বদলাতে চাইছেন।
যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে সরকারি নিরাপত্তা না পাওয়ায় হ্যারির করা মামলা সম্প্রতি শেষ হয়েছে। ওই মামলায় হ্যারি হেরে গেছেন। রাজার ছেলে রাজার সরকারকে রাজার আদালতেই চ্যালেঞ্জ করেছেন বলে বাকিংহাম প্রাসাদের জন্য এ মামলা ছিল অত্যন্ত অস্বস্তিকর।
প্রকাশ থাকে যে, এই মামলা চলাকালে বাবা-ছেলের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে গত মে মাসে বিবিসি নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ৪০ বছর বয়সী হ্যারি বলেছিলেন, ‘আমি পরিবারের সঙ্গে পুনর্মিলন চাই। জানি না, বাবার কত দিন বাকি আছে.. কিন্তু সব মিটমাট হলে ভালো লাগবে।’
বাবার অসুস্থতা নিয়ে হ্যারির এই বক্তব্য অনেকের কাছে কঠোর ও কটু মনে হয়েছে। কারণ, ক্যানসারের চিকিৎসা চললেও ৭৬ বছর বয়সী রাজা এখনো নিয়মিত অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন এবং দায়িত্বে থেকে তিনি মানসিক শক্তি পাচ্ছেন বলেও জানিয়েছেন। তবে মানুষ যা-ই মনে করুক, পর্যবেক্ষকেরা হ্যারির এই বক্তব্যে সমঝোতা বা পুনর্মিলনের ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন।
হ্যারির সর্বাধিক বিক্রিত ও আলোচিত স্মৃতিকথামূলক বই ‘স্পেয়ার’ রাজপরিবারের অশান্তি আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ওই বইয়ে তিনি দাদা প্রিন্স ফিলিপের শেষকৃত্যের পরের একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেখানে হ্যারি লিখেছেন, ভাই উইলিয়ামের সঙ্গে উত্তপ্ত তর্কের সময় বাবা তাঁদের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘ছেলেরা, দয়া করে আমার শেষ বয়সটাকে কষ্টের করে দিয়ো না।’
তখনো প্রিন্স চার্লস রাজা হননি। তখন তাঁর বয়স সত্তরের কোঠায়। আর তখন তাঁর ক্যানসারের খবরও জানা যায়নি। তবে আস্থার সংকটই তাঁদের বড় বাধা হয়ে আছে। বাকিংহাম প্রাসাদ যেমন পারিবারিক আলোচনার বিস্তারিত বাইরে না যাওয়ার নিশ্চয়তা চাইবে, তেমনি হ্যারি-মেগানও এখন নীরবতা বজায় রাখছেন। উভয় পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাতে চাইছে না।
এই যৌথ নীরবতা ইঙ্গিত দিচ্ছে, এবার হয়তো ক্যামেরার বাইরে, প্রচারবিমুখভাবে বাবা-ছেলের পুনর্মিলনের চেষ্টা করা হবে।
ওয়েলচাইল্ড পুরস্কার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হ্যারি আগামী সপ্তাহের ৮ই সেপ্টেম্বর লন্ডনে থাকবেন। ওয়েলচাইল্ড অসুস্থ শিশু ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তা দিয়ে থাকেন। এ ব্যাপারে নিজের সফরসূচি জানাতে গিয়ে হ্যারি বলেন, ‘ওয়েলচাইল্ড পুরস্কার অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া সব সময়ই আমার জন্য সম্মানের। তাঁদের গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় করুণা, সংযোগ আর সম্প্রদায়ের শক্তির কথা, যাদের শক্তি আর মনোবল আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে।’
হ্যারি আসন্ন এই লন্ডন সফরে আরও কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন। সেখানে তিনি যুক্তরাজ্যের দাতব্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করবেন। মূলতঃ যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলেও হ্যারি যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
বলা বাহুল্য, গত মে মাসেও হ্যারি নটিংহ্যামের এক দাতব্য সংস্থায় ব্যক্তিগতভাবে বড় অঙ্কের অনুদান দেন, যাতে দরিদ্র পরিবারগুলোকে খাদ্য সরবরাহ করা যায়। স্মরণ দিবসের অনুষ্ঠানে সামরিক বাহিনীর প্রয়াত সদস্যদের সন্তানদের সংগঠন স্কটি’স লিটল সোলজারসের জন্য মিছিলে অংশ নেয়া সব শিশুর হাতে মিষ্টি পাঠিয়েছিলেন হ্যারি।
এ থেকেই ধারণা করা যায়, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে হ্যারির সম্পর্ক এখনো দৃঢ়। কিন্তু উভয় পক্ষেই যে মানসিক ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা কাটাতে আস্থা অর্জনই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
অবশ্য, এখনো বড় বাধা রয়ে গেছে বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়ামের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে দূরত্ব এতটাই গভীর যে- আপাতত তাঁদের মিলনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। তাঁরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলেন না। দু’জনেই তাঁদের পরিবার ও স্ত্রীকে ঘিরে প্রবল সুরক্ষামূলক অবস্থানে আছেন। তাঁদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ তাই এখনো অনেক দূরের ব্যাপার।
তবে রাজা তৃতীয় চার্লসের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিছুটা আলাদা। আগামী মাসে যুক্তরাজ্যে হ্যারির সফর সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, বাবার সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের জন্য হতে পারে এক বিশেষ সুযোগ।
কারণ, বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হ্যারি বলেছিলেন, ‘আর লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে নেই…জীবন তো অমূল্য।’