মঙ্গলবার, ১৯শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’

‘মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা’

৭৪ Views

            সালাহ্উদ্দিন নাগরী\  ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা, তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালবাসা।’ লিখেছেন- অতুল প্রসাদ সেন। বাংলা আমার মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা, হৃদয়ের অনুভূতি প্রকাশের ভাষা। বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা এবং একই সঙ্গে দাপ্তরিক ভাষা। সব সরকারি অফিস ও কর্মপ্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষায় কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়; ভাষার জন্য আমাদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বব্যাপী ২১শে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। ফেব্রæয়ারি মাসে আমরা ভাষার প্রতি কতভাবেই না শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে থাকি। বাংলা বর্ণমালাখচিত সাদা-কালো পোশাকে শহিদবেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মাসব্যাপী বিভিন্ন আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, বইমেলায় যাওয়া, বই কেনা অনেকটা রুটিনে পরিণত হয়ে যায়। আর এতে করে অনেকেই মনে মনে ভাবি, ভাষার প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়তো যথাযথভাবে সম্পন্ন হলো। তাই মাস শেষ হলেই ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও একুশে চেতনা কেন জানি ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষাকে যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে, ব্যক্তি পর্যায়ে বাংলার প্রতি মনে হয় আমরা ততটুকু শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারি না। একইভাবে এ ভাষার প্রতি আমাদের দায়দায়িত্বও যথাযথভাবে পালন করতে পারি না।

            ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক পর্যায়ে ও কর্মক্ষেত্রে দৈনন্দিন কর্মকান্ডে বাংলা ভাষার প্রতি অনেক ক্ষেত্রে যথাযোগ্য সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা তো প্রকাশ পায়ই না, কোনো কোনো সময় অবজ্ঞার ভাবই ফুটে ওঠে। আধুনিক বা অতি আধুনিক হওয়ার জন্য শহরে বসবাসকারী কারও কারও দ্বারা ইদানীং যে বিষয় ও মূল্যবোধগুলো প্রথমেই আক্রান্ত হয়, বাংলা ভাষা সেসবের শীর্ষে।

            আমাদের সন্তানসন্ততি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়বে, অনর্গল ইংরেজি বলতে পারবে, এটা আমাদের জন্য আনন্দ ও গর্বের বিষয়। তবে সেটা বাংলা ভাষাকে অবশ্যই অবমূল্যায়ন করে নয়। অনেক অভিভাবককে অহরহ বলতে শুনি-‘আমার সন্তান তো বাংলা জানে না।’ এই ‘জানে না’ বলার মধ্যে এক ধরনের গর্ববোধ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা থাকে। হ্যাঁ, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ঠিকভাবে বাংলা পড়ানো হয় না বলে অনেকেই ভালোভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে পারে না। কিন্তু ‘বাংলা জানে না’-এর মধ্যে গর্ব করার কিছু নেই। গালভরে বলারও কোনো বিষয় নয়। আসলে এই ‘বাংলা জানে না’ বাক্যটি প্রয়োগ করে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, যেহেতু ‘বাংলা জানে না’, সেহেতু তারা ইংরেজিতে দক্ষ।

            এ দেশের আলো-বাতাসে বেড়ে উঠে যারা বাংলা লিখতে, পড়তে জানবে না, তারা কীভাবে এ দেশের মা-মাটি মানুষের হৃদয়স্পন্দন অনুভব করবে? কোন যোগ্যতা নিয়ে দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবে? তাদের মধ্যে কীভাবে দেশের প্রতি মমত্ববোধ আসবে? বাংলা না জানা ওইসব ছেলেমেয়েকে দোষ দেয়ার কিছু নেই। দোষ তাদের অভিভাবকদের। আমাদের একুশের চেতনা হতে পারে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর বাংলা বিষয়ের সিলেবাস সরকারি তত্ত¡াবধানে এমনভাবে প্রণয়ন করা, যেন শিক্ষার্থীরা অন্তত বাংলা লেখা ও পড়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।

            ফেসবুকের কল্যাণে বাংলা ভাষায় অনেকের দুর্বলতার বিষয়টি পরিস্ফুট হচ্ছে। ভুল বানানে বাংলা লেখা অনেকটা চর্চায় পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, অনুশোচনা নেই, এমনকি সংশোধন করারও কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর স্ক্রলের দিকে তাকালে বোঝা যায় কত অযতœ, অবহেলা ও অজ্ঞতার সঙ্গে শব্দ ও বাক্যগুলো লেখা হচ্ছে। বেসরকারি এফএম বেতার চ্যানেলগুলোয় ইংরেজি-বাংলা মেশানো উদ্ভট উচ্চারণের বাক্যালাপে আতঙ্কিত হতে হয়। সারা বছরের জন্য আমাদের একুশের চেতনা হতে পারে- শুদ্ধভাবে এবং শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলা ও লেখা।

            আমাদের সরকারি দপ্তর ও কর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বাংলায় নোট করা, ফাইল করা ও চিঠিপত্রে যোগাযোগ করা চালু হয়েছে বহু আগেই। তারপরও কোনো বিদেশি অতিথি বা অংশগ্রহণকারী থাকুক বা না থাকুক, অনেক সময় সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইংরেজি ভাষায় পরিচালনা করা হয়। ফলস্বরূপ অনেক অংশগ্রহণকারী ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকা সত্তে¡ও যথাযথ অবদান রাখতে পারেন না। প্রশ্ন হলো, আমাদের টার্গেট কি ওইসব অনুষ্ঠান থেকে সর্বোত্তম আউটপুট বের করে আনা, নাকি ইংরেজিতে পরিচালনার মাধ্যমে অনুষ্ঠানের স্মার্টনেস ধরে রাখা? কেউ যদি ইংরেজি বলতে পারে, তাহলে দাপ্তরিক কাজকর্মে তার দক্ষতা বাছবিচার ছাড়াই আমরা খুব দ্রæত সিদ্ধান্তে চলে আসি ‘অমুক কিন্তু চোস্ত অফিসার’। এ চিত্র হরহামেশা চোখে পড়ছে। আমাদের এ ধরনের মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকারি চিঠিপত্রে ইংরেজি তারিখের সঙ্গে বাংলায় সন-তারিখ লিখে আমাদের দায়িত্ব শেষ হবে না, দাপ্তরিক কার্যক্রমের সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ঘটাতে হবে। গ্রাহক সেবার সরকারি সব বিল ও পত্র বাংলায় প্রণয়ন করতে হবে।

            কোনো জাতির শ্রেষ্ঠত্ব আদায়ের জন্য, শৌর্যেবীর্যে শীর্ষস্থান দখলের জন্য জ্ঞানচর্চাই হলো অন্যতম পথ। জ্ঞানচর্চায় সেরা হওয়া গেলে অন্যান্য ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের আসনটি আপনাআপনি এসে হাজির হয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে ইসলামের বিজয় কেতন ওড়ার পর তা ধরে রাখার জন্য তারা সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছিলেন জ্ঞানচর্চার ওপর। তখন গ্রিক, রোমান সভ্যতা ও ভারতীয় সভ্যতার উল্লেখযোগ্য এমন কোনো রচনা অবশিষ্ট ছিল না যা মুসলিম মনীষীদের দ্বারা অনূদিত হয়নি।

            বাংলা ভাষায় সার্বিক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রটিকে আমরা এখনো বিস্তৃত করতে পারিনি। গবেষক, চিন্তক, জ্ঞানপিপাসুর জন্য বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি ও অন্যান্য শাখায় বাংলা ভাষায় লিখিত বা অনূদিত বইয়ের জোগান মজুত রাখতে পারিনি। বিশ্বসভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাসের ধারাবাহিক সংকলন আমাদের নেই। গ্রিক সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব শাখায় সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছে। সেই সভ্যতার সব মনীষীর রচনা এবং রোমান, ভারতীয় সভ্যতার প্রখ্যাত মনীষীদের গবেষণার সংকলন বাংলায় অনূদিত হয়নি। সাত শ সাল থেকে পনেরো শ সাল পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মশাল হাতে নিয়ে মুসলিম মনীষীরা সমগ্র পৃথিবীকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। সেসব মনীষীর গবেষণাকর্মের অনূদিত সংস্করণ আমাদের নেই, চিকিৎসাশাস্ত্রে ইবনে সিনার রচনা সমগ্র ‘কানুন’ পাঁচশ বছরব্যাপী অর্থাৎ সতেরো শ সাল পর্যন্ত ইউরোপের সব মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রধান পাঠ্যপুস্তক এবং যে কোনো জিজ্ঞাসার চূড়ান্ত ফয়সালা হিসাবে বিবেচিত হতো। সেই রচনাসমুহের অনুবাদ আমরা করিনি। মুসলিম মনীষীদের রেখে যাওয়া অবদান এবং সাত শ বছরের ইসলামি সভ্যতার নির্যাসের ওপর ভর করেই মূলত ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও আধুনিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছে। ইতিহাস তা-ই বলে।

            লেখাপড়া ছাড়া জ্ঞানের সীমা বৃদ্ধি পায় না আর মাতৃভাষা ছাড়া ভিন্ন ভাষায় জ্ঞানচর্চা অনেক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণতা পায় না বলেই হয়তো কবি বলেছেন, ‘বিনা স্বদেশী ভাষা মিটে কি আশা’। অপরিপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে বিশ্বচরাচরের তুমুল প্রতিযোগিতায় নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া যায় না। প্রতিবছর পৃথিবীর বড় বড় লেখক, গবেষক, বিজ্ঞানীদের যেসব প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে; সাহিত্য, চিকিৎসা, অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে প্রতিবছর যারা নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন, তাদের অবদানের বাংলায় অনূদিত সংকলন আমাদের নেই। দু-একজন অনুবাদকের বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে দু-চারটা বইয়ের অনুবাদ দিয়ে সব শ্রেণির গবেষক, চিন্তক, সংস্কারকের জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানো যাবে না। আমাদের অনুবাদকর্মের ওপর জোর দিতে হবে। অনুবাদকর্মে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক ও সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন, স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অনেক প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ভাষায় লিখিত পুরোনো আমলের বই, পুস্তক ও গবেষণাকর্ম ইংরেজিতে অনুবাদ করে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের সঙ্গে পরিচিত করার জন্য ৯ম শতকের বাগদাদের ‘বায়তুল হিকমা’র মতো আরেকটি লাইব্রেরি ও অনুবাদকেন্দ্র আমাদের প্রতিষ্ঠা করা দরকার। একুশ শতকে আমাদের একুশের লক্ষ্য হতে পারে পৃথিবীর তাবৎ ভালো পুস্তক, রচনা, প্রকাশনার বাংলায় নিয়মিতভাবে অনুবাদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

            আরেকটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি, যা হলো-সর্বস্তরে বাংলা চালুর এ প্রক্রিয়ায় ইংরেজি ভাষার অবস্থান ও প্রবেশাধিকার কতটুকু থাকবে, তা নির্ধারণ করা। একজন ইংরেজ বা ইংরেজি যার মাতৃভাষা, সে তার ভাষায় জ্ঞানচর্চায় বই, পত্র-পত্রিকা, বিভিন্ন রেফারেন্স, জার্নাল সবকিছুই পাচ্ছে। একজন জাপানি, রাশিয়ান, ফরাসি, জার্মান ইংরেজি না জেনেও নিজ ভাষায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের গবেষণা করতে পারছে। বিশ্বের বিভিন্ন শ্রমবাজারে জনবল প্রেরণের ক্ষেত্রে সমযোগ্যতাসম্পন্ন হয়েও ইংরেজিতে দুর্বলতার জন্য কিছু দেশের সঙ্গে, বিশেষত ভারত, শ্রীলংকা, ফিলিপাইনের সঙ্গে পেরে ওঠা যাচ্ছে না। ওই দেশগুলোর কিনার, ডে-লেবারার, সেলসম্যানসহ প্রায় সবাই কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো ইংরেজি জানে ও বলতে পারে। আমরা কি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা আরও ভালোভাবে শিখতে পারি না? ভারতে যাদের মাতৃভাষা হিন্দি নয়, তারা তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারে। সর্বস্তরে বাংলা চালু রেখেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখার ন্যূনতম একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার উপায় নির্ধারণের বিষয়টি মাথায় রাখা যেতে পারে।

            বাংলা ভাষার প্রতি সৎ ও দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে একে আরও সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত করার চেষ্টায় সবাইকে নিয়োজিত হতে হবে। এর প্রতিটি বর্ণ, শব্দ, বাক্যকে শুদ্ধভাবে লিখতে ও উচ্চারণ করতে হবে। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের অনেকেরই অবহেলার বিপরীতে এটি হতে পারে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অন্যতম পথ। আজকের এইদিনে বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের ভালবাসা আর ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

লেখকঃ সরকারি চাকরিজীবী

Share This