শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রেজিস্ট্রেশন ফি দ্বিগুণ করার ফলে বিড়ম্বনায় পড়েছেন  জমি এবং ফ্লাটের ক্রেতা-বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই

রেজিস্ট্রেশন ফি দ্বিগুণ করার ফলে বিড়ম্বনায় পড়েছেন জমি এবং ফ্লাটের ক্রেতা-বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই

            সাঈদ আহমেদ॥ এক খন্ড জমি বিক্রি করতে চান নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন সোনারগাঁও উপজেলার বাসিন্দা ফৌজিয়া আক্তার রুবি। দ্রুত বিক্রির জন্য জমির দামটা কম হাকেন তিনি। ক্রেতাও সাব্যস্ত হয়। রেজিস্ট্রি খরচ কত পড়বে, জানতে ক্রেতা ছুটে যান দলিল লিখকের কাছে। দলিল লেখক সম্ভাব্য খরচের কথা যা শোনালেন তা বিক্রেয় জমির মূল্যের প্রায় সমান। আইনমন্ত্রণালয় নির্ধারিত নিবন্ধন ফি’র বাইরে কাঠাপ্রতি ক্রেতাকে অতিরিক্ত গুণতে হবে ১ লাখ টাকা! সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় জমি কেনার ইচ্ছে পরিত্যাগ করেন ক্রেতা। বিষয়টি জানাতেই মাথায় বাজ পড়ে রুবির। ঝুলে যায় তার অতি জরুরি জমি বিক্রির কাজটি। শুধু রুবি নন। সোনারগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেই আটকে আছে জমির শত শত ক্রয়-বিক্রয়। কিন্তু কেন?

            এ প্রশ্নের উত্তর জানালেন, ওই সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক মো: সেলিম। তিনি বলেন, গত জুলাই মাস থেকেই এই অফিসে সাফ-কবলা জমি রেজিস্ট্রি হচ্ছে না। দানপত্র, এওয়াজ-বদল, আমমোক্তারনামা, বন্টননামা, না-দাবি, ঘোষণাপত্রের দলিল রেজিস্ট্রি হচ্ছে শুধু। আইন মন্ত্রণালয় নির্ধারিত নিবন্ধন ফি’র বাইরে এনবিআর অতিরিক্ত চাপিয়ে দিয়েছে উৎসে কর। এর ফলে জমির রেজিস্ট্রি খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে জমির মূল্যের অর্ধেক। কাঠাপ্রতি রাজস্ব বাড়ানো হয়েছে ১ লাখ টাকা। ফলে ৪০ লাখ টাকা মূল্যের জমি রেজিস্ট্রেশনের সঙ্গে অন্যান্য খরচ মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২৬ লাখ টাকা। জমি ক্রয় এখন ক্রেতার সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। দলিল লিখকদের মূল আয় সাফকবলা দলিল রেজিস্ট্রেশন থেকে। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দলিল লেখকরা নিদারুণ কষ্টে পতিত হয়েছে। দারুণ আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন ভেন্ডার, নকল নবীশ সহ রেজিস্ট্রি সংশ্লিষ্ট অন্যান্যরাও।

            শুধু সোনারগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসই নয়। নারায়ণগঞ্জ জেলাধীন সব সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের একই চিত্র। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী সাব- রেজিস্ট্রি অফিসের সাব-রেজিস্ট্রার, ভেন্ডার, দলিল লিখক, নকলনবীশ, উমেদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব জেলার সাব- রেজিস্ট্রি অফিসেও অভিন্ন চিত্র। তারা জানান, গত জুলাই মাস থেকে জমি রেজিস্ট্রেশন ফি দ্বিগুণ করা হয়েছে। ক্রেতার ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে বিড়ম্বনায় পড়েছেন জমি এবং ফ্ল্যাটের ক্রেতা, বিক্রেতাসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। আয়কর বিধিমালার ৬ ধারা অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্পত্তি নিবন্ধন কর ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাইরের এলাকা ও জেলা সদরে অবস্থিত পৌরসভায় ওই কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৬ শতাংশ। একই সঙ্গে সকল পৌরসভার আওতাধীন সম্পত্তি কর ২ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ এবং বাকি এলাকাগুলোতে ১ শতাংশ থেকে কর বাড়িয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। তবে রাজধানীর বিভিন্ন মৌজার জমির চুক্তিমূল্যের ৮ শতাংশ কিংবা এলাকাভিত্তিক কাঠা প্রতি সর্বনি¤œ কর নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজধানীতে রেজিস্ট্রি খরচ কোথাও শতকরা ৩০ শতাংশ। কোথাও ৪০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। গুলশানে ২৭ লাখ টাকার জমি কিনলে রেজিস্ট্রি খরচ পড়ছে ২৬ লাখ টাকা। নিবন্ধন ফি এই হারে বেড়ে যাওয়ায় সাফকবলা নিবন্ধন প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে । ফলে নিবন্ধন-সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা বেকার হয়ে পড়েছেন। ভোগান্তি বেড়েছে। কমেছে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আয়।

            কয়েকজন দলিল লেখক জানান, সঙ্কট শুধু এক দিকের নয়। উৎসে কর শতকরা ৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকা করা হয়েছে। যা পরিশোধ করতে হচ্ছে ক্রেতাকে। পিতার মৃত্যুর পর ওয়ারিশ সার্টিফিকেট দিয়ে রেজিস্ট্রি করার বিধান রয়েছে। কিন্তু নতুন ভূমি আইনের কারণে নামজারি ছাড়া দলিল রেজিস্ট্রি হচ্ছে না। তারা আরও জানান, সরকার কাঠাপ্রতি রেজিস্ট্রি খরচ নির্ধারণ করে দিয়েছে। অনলাইনে পে-অর্ডার জমা দেয়ায় কোনো কারণে হয়তো ওইদিন জমি রেজিস্ট্রি হলো না। জমাকৃত সেই টাকা ‘অফেরৎযোগ্য’ করা হয়েছে। সাফকবলা জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রি বন্ধ হয়ে যাওয়ার এটিও একটি কারণ।

            সাভার এলাকার এক দলিল লেখক জানান, কর বাড়ায় সাব কবলা রেজিস্ট্রি এক প্রকার বন্ধই হয়ে গেছে। জমির ক্রেতারা খরচের হিসেবে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। হঠাৎ এমন খরচের কথা শুনে অনেকের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে। এতে দলিল লেখকদের আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে দারুণ কষ্টে পড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে দলিল লেখক সমিতিগুলো কলম বিরতিসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। স্মারকলিপি দিয়েছে। নেতৃবৃন্দ আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন দফায় দফায়। তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দেন। কিন্তু ৩ মাস হতে চললেও বিষয়টির কোনো সুরাহা হয়নি।

            এদিকে এনবিআর একটি সূত্র দাবি করছে, দলিল নিবন্ধনের কর কমানো হয়েছে। তবে উৎসে করের কারণে জমি রেজিস্ট্রেশনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। স্থানভেদে কাঠাপ্রতি সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কর কমেছে। তবে বাস্তবতা ঠিক বিপরীত। দুয়েকটি শ্রেণিতে কর হ্রাস করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেড়েছে। বেশি বেড়েছে উপজেলা পর্যায়ে নিবন্ধন খরচ। তবে আরোপিত কর কমানো হবে কিনা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য জানাতে পারেনি সূত্রটি। আইনমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের বৃহত্তম রাজস্ব আয়ের খাত জমি নিবন্ধন। কিন্তু গত ২০শে জুন নতুন আয়কর আইন পাসের পর জমি ও ফ্ল্যাটের উৎসে কর দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সেই থেকে ধস নেমেছে জমি-ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রিতে। এ খাতে রাজস্ব আয়ে ভাটা এবং সমালোচনা ও বিতর্ক নিয়েই গত ৩রা অক্টোবর নিবন্ধন কর পুনর্নিধারণ করে এনবিআর। আগে সব ধরণের জমি নিবন্ধনে একই কর ধার্য ছিলো। নতুন হারে মৌজার অবস্থান অনুযায়ী জমিকে ৫ শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। পুন:ধার্য করা হয়েছে শ্রেণিভিত্তিক উৎসে কর।

            এদিকে জমি বা ফ্ল্যাট নিবন্ধন বন্ধ হয়ে গেছে-এমন অভিযোগের সঙ্গে দ্বি-মত পোষণ করেন মহা-পরিদর্শক নিবন্ধন (অতিরিক্ত দায়িত্ব) উম্মে কুলসুম। গত বুধবার তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, জমি নিবন্ধন কোথাও বন্ধ নেই। সাংবাদিকরা আমার কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে আমি জেলা রেজিস্ট্রারদের কাছ থেকে খবর নিয়েছি। রেজিস্ট্রেশন বন্ধ হয়ে গেছে-বিষয়টি এমন নয়। বরং আগে যে নিবন্ধন ফি ছিলো, আইন মন্ত্রণালয় সেটি ৫০ ভাগ কমিয়ে দিয়েছে। ‘ তাহলে ক্রেতা জমি রেজিস্ট্রেশনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন কেন ?’ জানতে চাইলে আইজিআর বলেন, এনবিআর উৎসে কর দ্বিগুণ করেছে। এ কারণে হয়তো মানুষ দলিল করতে এখন নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বিষয়টি এনবিআর সংশ্লিষ্ট। মনে হয় তাদের সঙ্গে কথা বললেই ভালো হয়। আমরা এনবিআরের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এটি নিয়ে কাজ করছে। মানুষ যদি রেজিস্ট্রি করতে না আসে-আমরাতো কিছু বলতে পারি না।

            উল্লেখ্য, করজাল বাড়াতে গত বাজেটে সব পৌরসভায় ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি বিক্রি করতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে শুধু সিটি করপোরেশন, জেলা সদরের পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় ১০ লাখ টাকা বেশি মূল্যের জমি, ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রয়, হস্তান্তর, বায়নানামা ও আমমোক্তারনামার ক্ষেত্রে এ বাধ্যবাধকতা ছিল।

            কিন্ত ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি সেবা গ্রহণ করতে রিটার্ন জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এর সঙ্গে আরও ছয়টি সেবা যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারের ভেন্ডর বা দলিল লেখক হিসাবে নিবন্ধন, লাইসেন্স বা তালিকাভুক্ত হতে; জমি, ভবন এবং অ্যাপার্টমেন্ট লিজ রেজিস্ট্রিকালে; সব পৌরসভায় ১০ লাখ টাকা বেশি মূল্যের জমি বিক্রি হস্তান্তর বা লিজ রেজিস্ট্রি করতে; ট্রাস্ট, ফান্ড, ফাউন্ডেশন, এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা এবং সমবায় সমিতির ব্যাংক হিসাব খুলতে; সিটি করপোরেশন এলাকায় বাড়ি ভাড়া বা লিজ গ্রহণকালে বাড়ির মালিকের; কোনো ব্যক্তি কর্তৃক পণ্য বা সেবা সরবরাহ গ্রহণকালে সরবরাহকারীর বা সেবা প্রদানকারীর রিটার্ন জমার স্লিপ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ সরকারি-বেসরকারি ৪৪টি সেবা পেতে রিটার্ন জমা দিতে হবে।

Share This

COMMENTS