রবিবার, ১০ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

শিক্ষার মানোন্নয়নে কিছু প্রস্তাবনা

শিক্ষার মানোন্নয়নে কিছু প্রস্তাবনা

৭০ Views

দীর্ঘ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার আলোকে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে বেসরকারি স্কুল কলেজ মাদরাসা সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য নিম্নে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছিঃ-

১) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের

কমিটি সম্পর্কেঃ

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও বিদ্যুৎসাহী সদস্য পদে সমপর্যায়ের বা তদুর্দ্ধ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান প্রধান বা অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান প্রধানকে মনোনয়ন দেয়া। কারণ প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত বিধি-বিধান সম্পর্কে যেমন বুঝবেন তেমন ফাঁকফোকরগুলো বুঝবেন। তাই তাকে ভুল বুঝিয়ে কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধি করা কঠিন হবে। অভিজ্ঞতা থাকায় প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতিতে তিনি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারবেন, অথচ সাধারণ মানুষ উক্ত পদগুলোতে অধিষ্ঠিত হলে আইন সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় তাকে ভুল বুঝিয়ে কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করা সহজ হয়।

২) আভ্যন্তরীণ অডিট কমিটির বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়াঃ

তিনজন শিক্ষক ও ২জন কমিটির সদস্যসহ মোট ৫জন, অথবা ২ জন শিক্ষক একজন কমিটির সদস্য মোট ৩ সদস্যের অডিট  কমিটি থাকা বাধ্যতামূলক করা। প্রতি সেশনে পুর্ব অভিজ্ঞতা বিনিময় ও আগের হিসাবের সমন্বয়ের স্বার্থে ৩ জনের একজন থাকবে, বাকি ২ জন পরিবর্তিত হবে। এ ভাবে সকল শিক্ষক পর্যায়ক্রমে এর অন্তর্ভুক্ত হবে। অডিট কমিটি গঠনের নিয়ম থাকলেও অনেক প্রতিষ্ঠান তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করেন না। উক্ত কমিটি প্রতিষ্ঠান চলাকালীন সময়ের বাইরে প্রতি মাসের হিসাব যাচাই করে প্রতিবেদন তৈরি করবেন। সভাপতির নিকট বেতন বিল স্বাক্ষরের সময় যে মাসের বেতন বিল তার পূর্ববর্তী মাসের অডিট প্রতিবেদনসহ বিল উপস্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। আয়ের টাকা ব্যাংকে যাবে, চাহিদা পত্র দিয়ে সভাপতি থেকে চেক স্বাক্ষর করিয়ে উত্তোলন করে ব্যয় করবে।

৩) প্রতিষ্ঠান প্রদানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করাঃ  মূলত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রধানের কোন ক্ষমতাই নেই। ধরা যাক কোন শিক্ষক/কর্মচারী অনিয়ম করল। প্রতিষ্ঠান প্রধান কমিটির মিটিংয়ে তা উপস্থাপন করবেন। স্থানীয় শিক্ষক কর্মচারী হলে বা কমিটির সাথে সম্পর্কিত বা রাজনৈতিক প্রভাবশালী হলে কমিটি এক্ষেত্রে প্রশ্রয় দিলে প্রতিষ্ঠান প্রধানের কিছুই করার থাকে না। ফলে একজনকে দেখে অন্যরাও অনিয়মে জড়িয়ে যায়। এতে করে প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হয়। এ জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশের কপি কমিটির নিকট উপস্থাপনের সাথে সাথে প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রশাসনের নিকট কপি প্রেরণ করবেন। কমিটি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা প্রশাসনকে জানানো বাধ্যতামূলক করা, সেই সাথে অন্তত সাময়িক বরখাস্তের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠান প্রধানের থাকা দরকার। সাময়িক বরখাস্তের পর তার অপরাধের ধরণ বুঝে কমিটি সাময়িক বরখাস্ত তুলে নেবে বা অপরাধ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। ডিজিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষকদের এসিআর প্রেরণ করবে, তারই ভিত্তিতে পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট প্রদান করা হবে। কমিটি রেজুলেশন করে প্রেরণ করলেও এসিআরের সাথে মিল করেই ডিজি তার উচ্চতর স্কেল/ পদোন্নতি দিবে বা  স্থগিত রাখবে।

৪) কেন্দ্র ফি কমানোঃ

পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র ফি বাস্তবে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষার কেন্দ্র ফি ছিল মাত্র একশত টাকা। এ টাকায় পরীক্ষা পরিচালনা সম্ভব হয়েছে। তাহলে বর্তমানে ৪০০/ ৫০০ টাকা কেন্দ্র ফি নির্ধারণের কোন প্রয়োজন আছে মনে হয় না। দাখিল আলিম পরীক্ষায় ১৩/১৪ বিষয়ের কেন্দ্র ফি যত, ফাযিল পরীক্ষার মাত্র ৪ বিষয়ের কেন্দ্র ফি তত। এ টাকা সচিব সম্মানী, স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সম্মানীর নামে ভাগ বাটোয়ারাই বেশি হয়। অনেক দরিদ্র ছাত্রের অভিভাবকের এ টাকা দিতে হিমশিম খেতে হয়। অপরদিকে পরীক্ষার শেষে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে হিসাব ও ভাউচারগুলো  অনুমোদন করিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক করা দরকার, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা করা হয় না। কেন্দ্রস্থিত প্রতিষ্ঠানের কমিটির নিকটও এ হিসাব  উপস্থাপন করার প্রয়োজন। আমার মতে কেন্দ্র ফি এর টাকা কেন্দ্রস্থিত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক  হিসেবে জমা হওয়া এবং ওই প্রতিষ্ঠানের ক্যাশ থেকে ব্যয় হওয়া দরকার। কারণ কেন্দ্রস্থিত প্রতিষ্ঠানের আয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় অনেক বেশি। তাই যদি সামান্য  ঘাটতি দেখা দেয় তা মাদরাসা বহন করার সুযোগ থাকবে। কারণ কেন্দ্রের ব্যয় বহন করে কেন্দ্র নিতেও অনেক প্রতিষ্ঠান আগ্রহী থাকে।

৫) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বন্ধ কমানোঃ বর্তমানে সপ্তাহে শুক্র শনি ২ দিন বন্ধ থাকে, তাই অন্যান্য বন্ধ কমিয়ে পাঠদান ঘন্টায় বৃদ্ধি করা দরকার।

৬) পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন যথাযথভাবে না হওয়াঃ পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন যথাযথভাবে সম্ভব হয় না। একজন পরীক্ষককে ৩০০ বা ততোধিক সংখ্যক উত্তরপত্র দেয়া হয় সময় দেয়া হয় ১৫ দিন। একজন পরীক্ষার্থী তিন ঘন্টায় যে উত্তরপত্র লিখে, তা ঠিকভাবে পড়লে কমপক্ষে আধা ঘন্টা সময় লাগবে। ইংরেজি, গণিতসহ বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলো আরো বেশি সময় লাগবে। তাছাড়া কভার পৃষ্ঠায় নম্বর উঠানো, বৃত্ত ভরাট, স্বাক্ষর দেয়া, প্যাকেট করা ইত্যাদি কাজে  প্রচুর সময়ের প্রয়োজন।  একজন পরীক্ষক একজন শিক্ষকও বটে। তিনি স্বাভাবিক সময় দশটা-চারটা শ্রেণীর কার্যক্রম পরিচালনা করার পর ২/৩ ঘন্টার বেশি উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় পাননা। দৈনিক ৩ ঘন্টা উত্তর পত্র মূল্যায়ন করলে ৩০০ উত্তর পত্রের প্রতিটি উত্তরপত্র মূল্যায়নে আধা ঘন্টা সময় ব্যয় হলে সময় লাগে পঞ্চাশ দিন। অথচ সময় দেয়া হয় ১৫ দিন। তাই তিনি কোন রকম পাতা উল্টিয়ে যান, অথবা অনভিজ্ঞ অন্য একাধিক ব্যক্তির সহযোগিতা নেন, এমনকি ঘরের বউ ছেলেমেয়েদের দিয়ে যেনতেন ভাবে মূল্যায়ন করান। ফলে মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না। ১৫ দিনের এক কিস্তি করায় প্রথম দিকে অলসতা করেন, শেষ দিকে তাড়াহুড়া করেন। তাই ৩০০ এর পরিবর্তে ১৫০টি উত্তরপত্র প্রদান, মূল্যায়ন ভাতা দ্বিগুণ করা, দুই কিস্তিতে উত্তর পত্র প্রেরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।  কোনভাবেই উত্তরপত্র ভালোভাবে না পড়ে যেন নাম্বার দেয়া না হয় এই বিষয়টি সতর্ক করা।

৭) পরিচ্ছন্ন কর্মী/ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর অপ্রতুলতাঃ

অল্প লোকের ব্যবহৃত তিন চারটি বেডরুমের একটি বাসা পরিচ্ছন্ন রাখতে একজন কাজের লোকের দরকার হয়, সেক্ষেত্রে শতশত শিক্ষার্থীর ব্যবহৃত ২০/৩০টি কক্ষ পরিচ্ছন্ন রাখতে কি পরিমাণ জনবল দরকার তা সহজে অনুমেয়। অপরিচ্ছন্নতা মশা মাছি বাহিত অনেক রোগ ছড়ায়। জনবল কম থাকায় কোন কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এ দায়িত্ব পালন করতে হয়। এতে অনেক জটিলতা দেখা দেয়। সম্প্রতি জেলা জজের মেয়েকে দিয়ে শ্রেণীকক্ষ ঝাড়ু দেয়ার বিষয়কে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠেছে। তাই উচ্চমাধ্যমিক বা তদুর্ধ্ব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে আরো একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ দেয়া দরকার।

৮) নির্বাচনে অংশগ্রহণঃ

বেসরকারি স্কুল কলেজ মাদরাসার শিক্ষক কর্মচারী মেম্বার, চেয়ারম্যান, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন পদে নির্বাচন করেন। শিক্ষক হলে অনেক সময় অন্য শিক্ষক দিয়ে তার শ্রেণী কার্যক্রম কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যায়। অফিস সহকারির কাজ অভিজ্ঞতা বিহীন নতুন কাউকে দিয়ে করানো কঠিন। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে ‘তিনি যদি নির্বাচিত হন প্রতিষ্ঠানের কোন সমস্যা হবে না, তার মেয়াদকালে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া হবে’  মর্মে প্রতিষ্ঠান থেকে কমিটির রেজুলেশনের সিদ্ধান্তের কপি মনোনয়ন পত্রের সাথে জমা দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

৯) আর্থিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধিঃ মাধ্যমিক স্তর, নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন ১০ হাজার টাকার মত। তাদের পক্ষে কিভাবে সংসার চালানো ও  সুষ্ঠুভাবে পাঠ দান সম্ভব ?

১০) স্কুল মাদরাসা বৈষম্য দূর করাঃ ধরা যাক প্রাইমারি স্কুল ১টি, হাই স্কুল ১টি, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ বা তদুর্ধ্ব পর্যায়ের কলেজ ১টি, তিন স্তরে মোট তিনটি ভবন বরাদ্ধ পেল। মাদরাসায় প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ স্তর সংযুক্ত,  সে হিসেবে তিনটি ভবন বরাদ্ধ পাওয়ার কথা। চার তলা সুরম্য ভবনগুলো প্রায় সকল স্কুল কলেজ পেয়েছে কিন্তু এখনো বহু মাদরাসা ১টি ভবন ও বরাদ্ধ পায়নি।  একটি জেলা,  উপজেলা সদরের  মাদরাসা এবং একই জেলা, উপজেলা সদরের কলেজের অবকাঠামোর দিকে তাকালে ভবন বরাদ্ধের সঠিক চিত্র ফুটে উঠবে। স্কুল কলেজের তিন স্তরের জনবল ও মাদরাসার সংযুক্ত তিন স্তরের জনবলের দিকে তাকালেও দেখা যাবে মাদরাসার জনবল অনেক কম। বর্তমান সরকার অনেকগুলো স্কুল কলেজকে সরকারি করণ করেছে মাদরাসা করা হয়নি। হাই স্কুলে ছাত্র যোগান দিতে অসংখ্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় (প্রায় প্রতি গ্রামে একটি) রয়েছে, মাদরাসায় ছাত্র যোগান দিতে কোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।  মাদরাসার ছাত্ররা সমমান পেয়েছে, পুরো শিক্ষা জীবন মাদরাসায় পড়াশোনা করেও চাকরির ক্ষেত্রে তারা যখন ইন্টারভিউ দিতে যায় মাদরাসার সিলেবাস থেকে এক পার্সেন্ট প্রশ্নও থাকে না। বর্তমান সরকার মাদরাসা শিক্ষারজন্য অনেক কিছু করেছে আশা করি উল্লেখিত বৈষম্য দূরীকরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো সরকারের নজরে আনতে যথাযথ ভুমিকা রাখবে।

নিবেদকঃ মোঃ ইয়াছিন মজুমদার, অধ্যক্ষ ফুলগাঁও ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসা, লাকসাম, কুমিল্লা। মোবাইলঃ ০১৯৭১৮৬৪৫৮৯

Share This