সম্পাদকীয় আত্মহত্যার প্রবনতা কমাতে হবে
বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। এই প্রবণতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। একদিকে, মানুষ বাঁচার জন্য প্রতিনিয়ত অসংখ্য সংগ্রাম করছে। অপরদিকে, ভুল সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে জীবন্ত স্বপ্নকে কফিনের কাপড়ে মুড়িয়ে দিচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী অসংখ্য স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে পা রাখেন। কিন্তু সেই ইচ্ছে আর পূরণ না করে ফিরে যান লাশ হয়ে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত মর্মান্তিক ও দুশ্চিন্তার বিষয়। এই কাতরে রয়েছে তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীরা। এর পেছনে জাতীয়, সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, মানসিক নির্যাতন বা ব্ল্যাক মেইল ও ব্যক্তির কারণ জড়িত। পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নেতিবাচক প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিও মানুষের মধ্যে বিষন্নতা তৈরির অন্যতম কারণ। আমাদের সমাজের একটা ধারা আছে, কম প্রশংসা করা এবং বেশি দোষ খোঁজার চেষ্টা করা। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই চল রয়েছে।
বিভিন্ন পত্রিকার তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত এই ৮ মাসে ৩৬১ জন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সমীক্ষার তথ্য বলছে, গত ৮ মাসে গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ৪৫.১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। আর ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মাঝে ছেলে শিক্ষার্থী ১৪৭ জন, আর মেয়ে শিক্ষার্থী ছিল ২১৪ জন। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে সারাদেশে ২০২২ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহননের পথ বেছে নেয়া এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৪০ জন স্কুল পর্যায়ের। এছাড়া কলেজ পর্যায়ে ১০৬ জন ও সমমান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাদরাসাগামী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
২০২১ সালে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ৭৯ জন। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে মেয়েদের আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছেলেদের। আবার আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ায় ৪ জন, শিক্ষকের মাধ্যমে অপমানিত হয়ে ৬ জন, গেম খেলতে বাধা দেয়ায় ৭ জন, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ২৭ জন আত্মহত্যা করেছে। এ ছাড়া মুঠোফোন কিনে না দেয়ায় ১০ জন, মোটর সাইকেল কিনে না দেয়ায় ৬ শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশে প্রতি বছর কমপক্ষে ১৩ হাজার থেকে ৬৪ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। দেশে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখ মানুষে কমপক্ষে ৭ দশমিক ৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৬ জন। দেশে গত বছর স্কুল, কলেজ ও মাদরাসাগামী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতি মাসে গড়ে ৩৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। নারী শিক্ষার্থীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ খতিয়ে দেখা যায়, ২৬.৬০% নারী শিক্ষার্থী অভিমান করে, প্রেমঘটিত কারণে ১৮.৭০%, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮.৪০%, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৯.৮০%, ৫.১০% শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির কারণে এবং পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে ১২.৬০% আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যার প্রবণতা কমানোর জন্য ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সচেতনতার বিকল্প নেই। তার মধ্যে জাতীয় হটলাইন চালু করা যেন মানসিক চাপ সৃষ্টি হলে কল দিয়ে সমাধান করতে পারে। শিক্ষার্থীদের অনলাইন থেকে দূরে রাখা, নারী শিক্ষার্থীদের অনলাইনে আপত্তিকর টেক্সট, অডিও কিংবা ভিডিও শেয়ার না করা, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টের জন্য প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পেইন করা, বিভিন্ন কঠিন পরিস্থিতিতে মানসিক অবস্থা চাঙ্গা রাখার কৌশল শেখানো উল্লেখযোগ্য বলে আমরা মনে করি।