বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সৌদি আরবের যুবরাজ সালমানের উত্থানের নেপথ্যে:

সৌদি আরবের যুবরাজ সালমানের উত্থানের নেপথ্যে:

৩১ Views

            ষ্টাফ রিপোর্টার\ তখন ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাস, সৌদি আরবের ৯০ বছর বয়সী বাদশাহ আবদুল্লাহ তখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। তার সৎ ভাই সালমান পরবর্তী বাদশাহ হতে চলেছেন। সালমানের প্রিয় ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

            যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান শুধুমাত্র তার নামের আদ্যর এমবিএস নামে পরিচিত ছিলেন এবং তখন তার বয়স মোটে ২৯ বছর। এই বয়সেই তার নিজ দেশ নিয়ে এক বড় পরিকল্পনা ছিল, যা ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিকল্পনা। তবে তার আশঙ্কা ছিল যে নিজের সৌদি রাজপরিবারের ভেতরে থাকা চক্রান্তকারীরা শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।

            তাই ওই জানুয়ারি মাসের এক মধ্যরাতে, তিনি শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে প্রাসাদে ডেকে পাঠান, তার আনুগত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। সাদ আল-জাবরি নামের ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে বলা হয়েছিল তার মোবাইল ফোনটি বাইরে একটি টেবিলে রেখে আসতে। এমবিএসও একই কাজ করেন। দু’জন তখন একদম একা।

            তরুণ যুবরাজ প্রাসাদের গুপ্তচরদের এতটাই ভয় পেতেন যে সেখানকার একমাত্র ল্যান্ডলাইন টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে তিনি দেয়াল থেকে সকেটটি টেনে খুলে ফেলেন। আল-জাবরির মতে, এমবিএস তখন আলোচনা করছিলেন যে কীভাবে তিনি তার দেশকে ‘গভীর ঘুম’ থেকে জাগিয়ে তুলবেন, যাতে তার দেশ বিশ্বমঞ্চে সঠিক জায়গা করে নিতে পারে।

            বিশ্বের সবচেয়ে লাভজনক কোম্পানি, রাষ্ট্রীয় তেল উৎপাদক আরামকোর একটি অংশ বিক্রি করে তিনি তার অর্থনীতিকে তেলের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনতে শুরু করবেন।

            তিনি সিলিকন ভ্যালির টেক স্টার্টআপগুলোয় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন, যার মধ্যে রয়েছে ট্যাক্সি কোম্পানি, উবার। এরপর সৌদি নারীদের কাজ করার স্বাধীনতা দিয়ে তিনি ৬০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন।

            বিস্মিত হয়ে আল-জাবরি যুবরাজকে তার উচ্চাকাঙ্খার পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সহজ ভাষায় জানতে চান, আপনি কি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের কথা শুনেছেন?

            তখনই কথোপকথন শেষ করেন এমবিএস। মধ্যরাতের একটি বৈঠক, যা আধা ঘণ্টার মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সেটা তিন ঘণ্টা ধরে চলে। আল-জাবরি ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর তার মোবাইলে বেশ কয়েকটি মিসড কল দেখতে পান।

            দীর্ঘ সময় তার কোনো খোঁজ না থাকায় তার সরকারি সহকর্মীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। এখানে এমন এক ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে, যিনি সৌদি আরবের ক্ষমতায় অসাধারণ উত্থান লাভ করেছেন। যিনি সৌদি আরব পরিচালনা করেন এবং যার তেল নিয়ন্ত্রণ সবার ওপর প্রভাব ফেলেছে। কীভাবে তিনি শত শত প্রতিদ্ব›দ্বীকে হারিয়ে ক্রাউন প্রিন্স হয়েছেন, সেই থেকেই এই গল্পের শুরু হয়েছে।

            গত এক বছর ধরে, বিবিসির ডকুমেন্টারি নির্মাতা দল সৌদি আরবে এমবিএসের বন্ধু এবং বিরোধী উভয়ের সঙ্গে কথা বলেছে। পাশাপাশি সিনিয়র পশ্চিমা গুপ্তচর এবং কূটনীতিকদের সঙ্গেও কথা বলেছে।

            সৌদি সরকারকে বিবিসির এই প্রামাণ্য চিত্রে এবং এই নিবন্ধে করা দাবির জবাব দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে তারা কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।

            সাদ আল-জাবরি সৌদি নিরাপত্তা যন্ত্রের এত উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন যে তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ব্রিটিশ সরকারের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্স এর প্রধানদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব ছিল।

            সৌদি সরকার আল-জাবরিকে একজন অযোগ্য সাবেক কর্মকর্তা বলে অভিহিত করলেও, তিনি দেশটির অন্যতম তথ্যসমৃদ্ধ ব্যক্তি যিনি সৌদি আরবের যুবরাজ কীভাবে দেশ শাসন করেন সেই সম্পর্কে কথা বলার সাহস করেছেন। তিনি বিবিসিকে যে বিরল সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাতে আশ্চর্যজনক বহু তথ্য আছে। বিবিসি মূলত সেই ঘটনাগুলোর ওপর আলোকপাত করে যা এমবিএসকে কুখ্যাত করে তুলেছিল।

            এর মধ্যে রয়েছে ২০১৮ সালে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোজির হত্যাকান্ড এবং ইয়েমেনে এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের সূচনা।

            এমবিএস-এর বাবা ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ায়, ৩৮ বছর বয়সী এমবিএস এখন ইসলামের জন্মস্থান এবং বিশ্বের বৃহত্তম তেল রফতানিকারক দেশের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি সাদ আল-জাবরির কাছে বলা অনেক যুগান্তকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বাক-স্বাধীনতা দমন, অনেক মৃত্যুদন্ড দেওয়া এবং নারী অধিকার কর্মীদের জেলে পাঠানোসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো অভিযোগের মুখোমুখি হন।

            সৌদি আরবের প্রথম বাদশাহ এমবিএসের বাবা সালমানসহ অন্তত ৪২টি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। ঐতিহ্যগতভাবে এই ছেলেরাই পরপর মসনদে বসতেন। ২০১১ এবং ২০১২ সালে তাদের দু’জন হঠাৎ মারা গেলে সালমানকে উত্তরাধিকারের সারিতে উন্নীত করা হয়।

            রাশিয়ার ক্রেমলিনে কে কার পরে ক্ষমতায় আসতে পারেন, সে দিকে যেমন পশ্চিমা গোয়েন্দারা তীক্ষè নজর রাখেন, ঠিক সেভাবেই সৌদি মসনদে কে কার পরে বসতে পারেন সেটাও ক্রমশ তাদের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।

            এই পর্যায়ে, এমবিএস এতটাই তরুণ এবং অপরিচিত ছিলেন যে তিনি তাদের নজরেই ছিলেন না। তিনি তুলনামূলকভাবে কিছুটা আড়ালে বেড়ে উঠেছেন’, ২০১৪ সাল পর্যন্ত এমআই-সিক্স এর প্রধান থাকা স্যার জন সাওয়ারস বলছেন। কারণ তিনি ক্ষমতায় আসীন হবেন এটা কেউ ভাবেনইনি!

            ক্রাউন প্রিন্স এমন এক প্রাসাদে বেড়ে ওঠেন যেখানে খারাপ আচরণের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি ব্যবস্থা ছিল না। থাকলেও খুবই নগণ্য।

            তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সেটার প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করেন না এবং চিন্তা ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, প্রাসাদের এমন পরিবেশ তার সেই কুখ্যাত অভ্যাসগুলোর পেছনে ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে সাহায্য করতে পারে। এমবিএস তার কিশোর বয়সে রিয়াদে সর্বপ্রথম কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন, যখন তাকে আবু রাসাসা বা বুলেট বাবা নাম দেওয়া হয়েছিল।

            তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি এক বিচারককে পোস্টে একটি বুলেট পাঠিয়েছিলেন। ওই বিচারক রাজ পরিবারের সম্পত্তির বিরোধে এমবিএস-এর দাবি অগ্রাহ্য করেছিলেন। তার নির্মমতা আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, স্যার জন সাওয়ারস লক্ষ্য করেন। তাকে কেউ ছাড়িয়ে যাবে এটি তিনি পছন্দ করতেন না। কিন্তু এর মানে এটাও বোঝায় যে তিনি সৌদি আরবে এমন সব পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন যা অন্য কোনো সৌদি নেতা করতে পারেননি।

            সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে একটি হল তিনি বিদেশি মসজিদ এবং ধর্মীয় স্কুলগুলোতে সৌদি অর্থায়ন বন্ধ করে দেন, যে প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামি জিহাদিবাদের প্রজনন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল।

            এই পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলোর নিরাপত্তায় বিশাল সুবিধা বয়ে আনে। সাবেক এমআই-সিক্স প্রধান এসব কথা বলেন। এমবিএস এর মা, ফাহদা, একজন বেদুইন উপজাতি নারী এবং তার বাবার চার স্ত্রীর মধ্যে ফাহদাকে সবচেয়ে প্রিয় হিসেবে দেখা হয়।

            পশ্চিমা কূটনীতিকদের ধারণা, বাদশাহ সালমান অনেক বছর ধরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা ভাস্কুলার ডিমেনশিয়া (ধীরে ধীরে সব ভুলে যাওয়া) রোগে ভুগছিলেন। তিনি যেকোনো সাহায্যের জন্য তার ছেলে এমবিএস-এর মুখাপেক্ষী ছিলেন।

            বেশ কয়েকজন কূটনীতিক এমবিএস এবং তার বাবার সাথে তাদের বৈঠকের অভিজ্ঞতার কথা বিবিসির সাথে শেয়ার করেন। যুবরাজ একটি আইপ্যাডে নোট লিখতেন, তারপর সেগুলো তার বাবার আইপ্যাডে পাঠাতেন, তিনি পরবর্তীতে কী বলবেন সে বিষয়ে ধারণা দেয়ার জন্য এই কাজটি করতেন তিনি।

            যুবরাজ দৃশ্যত তার বাবার বাদশাহ হওয়ার জন্য এতটাই অধৈর্য ছিলেন যে ২০১৪ সালে তিনি তার চাচা তৎকালীন স¤্রাট আবদুল্লাহকে রাশিয়া থেকে প্রাপ্ত একটি বিষযুক্ত আংটি দিয়ে হত্যা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

            আমি নিশ্চিতভাবে জানি না যে তিনি কেবল আস্ফালনের ছলে কথাগুলো বলেছিলেন কিনা, তবে আমরা একে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছিলাম, আল-জাবরি বলেন।

            এ নিয়ে সাবেক এক শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, তিনি এমবিএসের একটি গোপনে রেকর্ড করা নজরদারি ভিডিও দেখেছেন, যেখানে বাদশাহকে এই বিষ প্রয়োগের ব্যাপারে এমবিএস-এর অভিপ্রায়ের কথা উঠে আসে।

            তাকে আদালত থেকে নিষিদ্ধ করা হয়, অনেক দিন রাজার সাথে তার হাত মেলানো নিষিদ্ধ ছিল। প্রকৃতপক্ষে, বাদশাহ আবদুল্লাহ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন, যার ফলে ২০১৫ সালে তার ভাই সালমান সিংহাসনে আরোহণ করেন। এমবিএস প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান এবং দায়িত্ব পাওয়ার পর পর কোনও সময় নষ্ট করেননি তিনি যুদ্ধে যাওয়ার ক্ষেত্রে। তথ্যসূত্র: বিবিসি/ যুগান্তর

Share This