শনিবার, ১৫ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

স্বাধীনতার অর্ধশতকেও সংরক্ষণ হয়নি  অরক্ষিত মনোহরগঞ্জের মানরা গণকবর

স্বাধীনতার অর্ধশতকেও সংরক্ষণ হয়নি অরক্ষিত মনোহরগঞ্জের মানরা গণকবর

৭৭ Views

            কুদরত উল্যাহ॥ স্বাধীনতার অর্ধশতকেও কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার হাসনাবাদ ইউনিয়নের মানরা গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদদের গণকবরটি সংরক্ষণ করা হয়নি। ওইদিন নিহত শহীদের স্বীকৃতিও মেলেনি।

            ১৯৭১ সালে আগস্টের মাঝামাঝি ওই গ্রামের দু’টি বাড়িতে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে এক নারীসহ ১৫ জন গণহত্যার শিকার হন। ওই সময় এলাকাটি ছিল কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার অধীনে। প্রথম হত্যাযজ্ঞ হয় বর্তমান মনোহরগঞ্জ উপজেলার মানরা গ্রামের মুন্সিবাড়িতে। বাড়ির উঠানে আটজনকে সামনে ও পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন নিহত রৌশন আলী মুন্সির ছোট ছেলে জহিরুল ইসলাম মুন্সি এখনও বেঁচে আছেন।

            এ প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় তার। শহীদ পরিবারের এই সন্তান বলেন, শনিবারের ভোররাত। সম্ভবত দিনটি ছিল ভাদ্র মাসের ২২ তারিখ। সেই হিসাবে সময়টা একাত্তরের আগস্টের মাঝামাঝি। বাড়ির বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন ঘুমে। কেউ কেউ ফজরের নামাজ আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জহিরুল মুন্সির ভাষ্য, “পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে আমরা তিন ভাই পাশের গ্রামে বোনের বাড়িতে থাকায় সেদিন রক্ষা পাই। খবর পেয়ে সকাল ৮টার দিকে বাড়ি এসে দেখি লাশ আর লাশ। পুরো উঠান রক্তে ভেসে গেছে। গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছে। আমার সঙ্গে তখন তিন-চার জন আত্মীয় ছিলেন। আমরা লাশগুলো একত্র করলাম। হানাদাররা আবার আসতে পারে, সে ভয়ে কাঁপছিলাম। এ অবস্থায় আমরা ক’জন মিলে কারও কাছ থেকে চাদর, কারও কাছ থেকে মহিলাদের নামাজের সাদা কাপড় সংগ্রহ করলাম। এসব দিয়েই নিহত সবাইকে একসঙ্গে দাফন করি। “সেদিন মৃত ভেবে রেখে যাওয়া আমার দুই ভাই নুরুল হক মুন্সি ও একরামুল হক ওরফে কালা মিয়া মুন্সি পরবর্তীতে চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হন। দুই দশক আগে মারা যান। আমৃত্যু গুলির যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটিয়েছেন তারা।”

            স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হলেও তাদের কারও কপালে জোটেনি কোনো স্বীকৃতি। আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন স্বীকৃতি না পাওয়া শহীদ পরিবারের এ সন্তান।

            “২০০১ সালে সাবেক সংসদ সদস্য এম আনোয়ারুল আজিম গণকবর সংরক্ষণের জন্য একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ ও কিছু টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্মৃতি ফলকটি অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে,” বলেন জহিরুল। পাক বাহিনীর হাতে বাবা, চাচা ও চাচাতো ভাইদের প্রাণ দেয়ার স্বীকৃতি ও সরকারিভাবে গণকবরটি সংরক্ষণ হোক- এটাই এখন তার একমাত্র চাওয়া। যেন  এ ত্যাগের কথা নতুন প্রজন্ম জানতে পেরে শহীদদের সম্মান জানাতে পারে।

            এ বিষয়ে মনোহরগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল আজিজ বলেন, কোনো অপরাধ ছাড়াই সেদিন মানরা গ্রামে নিরীহ মানুষদের খুনের উৎসবে মেতে ওঠেছিল পাকিস্তানিরা। ওই ১৫ জন সেদিন গণশহীদ হয়েছিলেন। আবদুল আজিজ বলেন, “২০২০ সালে সরকারিভাবেই ওই গণকবরটি সার্ভে করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুতই এটি সংরক্ষণ করে এসব শহীদদের সম্মান জানানো হবে।”

            মনোহরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহরিয়া ইসলাম বলেন, গণকবর সংরক্ষণের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প আছে। ওই প্রকল্পে যুক্ত করার জন্য মানরার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২০ সালে গণকবরটি সার্ভে করে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। তবে প্রকল্পের তালিকায় এখনও যুক্ত হয়নি। “আমরা বিষয়টির খোঁজ-খবর রাখছি। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই ওই প্রকল্পের আওতায় গণকবরটি সংরক্ষণ করা হবে। আমরাও চাই কবরটি সংরক্ষণের মাধ্যমে সেদিনের গণশহীদদের প্রতি সম্মান জানাতে।

Share This