রবিবার, ১০ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

হাদিসের বর্ণনায় নারী-পুরুষের নামাজ

১৪ Views

            মুফতি মাহমুদ হাসান\ শারীরিক গঠন, শক্তি-সক্ষমতা নানা বিষয়ে যেমন নারী-পুরুষের পার্থক্য আছে, তেমনি বিভিন্ন ইবাদতসহ শরিয়তের অনেক বিষয়ে পার্থক্য থাকা একটি সর্বজনবিদিত বিষয়। এর ভিত্তিতেই নামাজের মৌলিক বিষয় এক হলেও তা আদায়ের পদ্ধতিতে কিছু বিধানে পুরুষ ও নারীর পার্থক্য আছে। যেমন- নামাজে পুরুষের সতর ঢাকা আবশ্যক হলো নাভির নিচ থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত, পক্ষান্তরে নারীদের চেহারা ও হাতের কবজি পর্যন্ত অংশ ছাড়া পুরো শরীর ঢাকা ফরজ। তাদের সতরের পরিমাণ বেশি হওয়ায় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তাদের বিধানগুলো দেয়া হয়েছে।

            মুসলিম উম্মাহর প্রায় দেড় হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন আমলও অনুরূপ। বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস, সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেঈদের বর্ণনার মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। এখানে আমরা পুরুষ ও নারীর নামাজের নিয়মে পার্থক্যগুলো নিয়ে গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদিস, সাহাবা-তাবেঈদের ফতোয়াসহ আলোচনা করব, ইনশাআল্লাহ।

দাঁড়ানো অবস্থায় পার্থক্য

১. পুরুষ উভয় পায়ের মধ্যে কমপক্ষে চার আঙুল পরিমাণ ফাঁকা রাখবে। আর নারীরা উভয় পা সম্পূর্ণ মিলিয়ে দাঁড়াবে। ইবনে আব্বাস (রা.)-কে নারীদের নামাজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, নারীরা (নামাজের সকল রুকন আদায়ে) খুব জড়সড় হয়ে স্বীয় শরীরকে গুটিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৭৯৩)

২. পুরুষ তাকবিরে তাহরিমার সময় উভয় হাত চাদর ইত্যাদি থেকে বের করবে। নারীরা চাদর বা ওড়নার ভেতর থেকে হাত বের করবে না।

            আয়শা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সাবালক নারীর নামাজ ওড়নাবিহীন আল্লাহর কাছে কবুল হবে না।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৬৪১)

            আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা নারীর নামাজ কবুল করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তার পূর্ণ শরীর ঢেকে নেয়।’ (আল-মুজামুল আওসাত : হাদিস ৭৬০৬)

৩. পুরুষ তাকবিরে তাহরিমার সময় উভয় হাত কানের লতি পর্যন্ত ওঠাবে, আর নারীরা ওঠাবে কাঁধ পর্যন্ত। ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, হে ওয়ায়েল! যখন তুমি নামাজ পড়বে তোমার হস্তদ্বয় কান বরাবর ওঠাবে। আর নারীরা হস্তদ্বয় স্তন বরাবর রাখবে। ’ (আল-মুজামুল কাবির, হাদিস : ২৮)

            তাবেঈ জুহরি (রহ.) বলেন, ‘নারীরা উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত ওঠাবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৪৭২)

৪. পুরুষ তাকবিরে তাহরিমার পর নাভির নিচে হাত বাঁধবে, আর নারীরা বুকে হাত বাঁধবে। আসেম আহওয়াল (রহ.) বলেন, ‘আমি হাফসা বিনতে সিরিন (রহ.)-কে নামাজের তাকবির দিতে দেখেছি এবং তিনি স্তন বরাবর রাখার প্রতি ইঙ্গিত করলেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৪৭৫)

            ইবনে জুরাইজ (রহ.) বলেন, ‘আমি আতা (রহ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, নারীরা তাকবিরের সময় পুরুষদের মতো হাত ওঠাবে? উত্তরে তিনি বলেন, নারীরা পুরুষদের মতো হাত ওঠাবে না এবং তিনি ইশারায় দেখালেন, তাতে তাঁর হস্তদ্বয় অনেক নিচু করলেন এবং শরীরের সঙ্গে হাতকে একেবারে মিলিয়ে নিলেন এবং বললেন, নারীদের শরীরের গঠন পুরুষদের মতো নয়।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৪৭৪)

            উক্ত বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে নারীদের শারীরিক গঠনের দিকে লক্ষ্য করে নারী ও পুরুষের হাত ওঠানো ও বাঁধার স্থান ভিন্ন ভিন্ন হওয়াটাই সমীচীন। বিভিন্ন হাদিস থেকেও এটা প্রতিভাত হয় যে নারীদের বেলায় সর্বাধিক সতর হওয়ার দিকটি বিবেচ্য ও প্রণিধানযোগ্য। এতে বোঝা যায়, নামাজের সব রুকনে নারীদের শরীর যে পদ্ধতিতে বেশি ঢাকা যায় সেই পদ্ধতি গ্রহণের নির্দেশ। যেহেতু নারীরা বুকে হাত বাঁধলে তাদের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো বেশি ঢাকে, তাই নারীরা বুকে বাঁধবে। পক্ষান্তরে পুরুষ হাত বাঁধবে নাভির নিচে। এটাই সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। ওয়ায়েল ইবনে হুজর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নামাজে ডান হাত বাঁ হাতের ওপর রেখে নাভির নিচে রাখতে দেখেছি। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ৩৯৫৯)।      কোনো কোনো বর্ণনায় পুরুষের বেলায় বুকে হাত বাঁধার কথা পাওয়া গেলেও হাদিসবিশারদরা সেসব বর্ণনাকে অতি দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।

রুকু অবস্থায় পার্থক্য

১. পুরুষ রুকু অবস্থায় এই পরিমাণ ঝুঁকবে, যেন কোমরের নিম্নাংশ সোজা হয়ে যায় এবং মাথা ও নিতম্ব বরাবর হয়ে যায়। আর নারীরা এই পরিমাণ ঝুঁকবে, যেন উভয় হাত শুধু হাঁটু পর্যন্ত পৌঁছে।

            আয়শা বিনতে সাদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি রুকুতে খুব বেশি ঝুঁকতেন, যা দৃষ্টিকটু। তাই সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) তাঁকে বলেন, ‘তোমার দুই হাত হাঁটুতে রাখলেই তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৫৭৭)

২. পুরুষ রুকুতে হাতের আঙুল খোলা রেখে হাঁটু শক্ত করে ধরবে, আর নারীরা শুধু আঙুল মিলিয়ে হাঁটুর ওপর রাখবে। (মারাকিল ফালাহ : পৃষ্ঠা-১৪১)

৩. পুরুষ রুকুতে বাহু বগল থেকে পৃথক রাখবে, আর নারীরা বাহু বগলের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে।

            তাবেঈ আতা (রহ.) বলেন, নারীরা রুকু অবস্থায় যথাসম্ভব শরীর গুটিয়ে ও মিলিয়ে রাখবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৫০৬৯)

সিজদা অবস্থায় পার্থক্য

১. পুরুষ সিজদা অবস্থায় হাত জমিন থেকে, রান পেট থেকে এবং বাহু বগল থেকে পৃথক রাখবে। নারীরা হাত জমিনের সঙ্গে, রান পেটের সঙ্গে এবং বাহু বগলের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে।

২. পুরুষ সিজদায় উভয় পা খাড়া রাখবে এবং পায়ের আঙুলগুলো কিবলার দিকে রাখবে, নারীরা উভয় পা ডান দিকে বের করে দেবে। ইয়াজিদ ইবনে হাবিব (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার দু’জন নারীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তারা তখন নামাজ পড়ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা সিজদা করবে শরীরকে জমিনের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে, কেননা এ ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থা পুরুষদের মতো নয়।’ (মারাসিলে আবি দাউদ, হাদিস : ৮৭; সুনানুল বায়হাকি, হাদিস : ৩২০১)

            ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নারীরা যখন সিজদা করবে, পেট রানের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়ে রাখবে, যাতে ভালোভাবে সম্পূর্ণ সতর ঢাকা হয়ে যায়। (সুনানুল বায়হাকি, হাদিস : ৩১৯৯)

            ইবরাহিম নাখঈ (রহ.) বলেন, ‘যখন নারীরা সিজদা করবে, পেট রানের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে, তার নিতম্ব উঁচু করবে না, এবং পুরুষের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফাঁকা রাখবে না।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৭৮২, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক, হাদিস : ৫০৭১)

বসা অবস্থায় পার্থক্য

            পুরুষ বসা অবস্থায় ডান পা খাড়া রেখে বাঁ পা বিছিয়ে তার ওপর বসবে এবং হাতের আঙুলগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক ফাঁকা রাখবে। আর নারীরা উভয় পা ডান দিকে বের করে দিয়ে নিতম্ব জমিনের ওপর রেখে বসবে এবং হাতের আঙুলগুলো একদম মিলিয়ে রাখবে। ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নারীরা যখন নামাজে বসবে তখন এক ঊরু অন্য ঊরুর ওপর রাখবে।’ (সুনানুল বায়হাকি, হাদিস : ৩১৯৯)

            আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) পুরুষদের তাশাহহুদ অবস্থায় ডান পা খাড়া রেখে বাঁ পা বিছিয়ে বসার নির্দেশ দিয়েছেন। আর নারীদের উভয় পা ডান দিকে বের করে দিয়ে নিতম্ব জমিনের ওপর রেখে বসার নির্দেশ দিয়েছেন।’ (সুনানুল বায়হাকি, হাদিস : ৩১৯৮)

            এ ছাড়া এ আমল সফিয়্যা (রা.)সহ ইবনে ওমর (রা.)-এর ঘরের অন্য নারীদের থেকেও প্রমাণিত। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ২৭৮৪)

Share This

COMMENTS