রবিবার, ২৯শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

হারিয়ে যাচ্ছে ইসলামি শিক্ষার প্রথম সোপান মক্তব

হারিয়ে যাচ্ছে ইসলামি শিক্ষার প্রথম সোপান মক্তব
Views

            মো. আমিনুল ইসলাম মজুমদার\ ইসলামি শিক্ষার প্রচার-প্রসারে অন্যতম একটি শিক্ষা কেন্দ্র হচ্ছে মক্তব। যেটি ইসলামি শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হিসেবে বিবেচিত। মক্তব শব্দেটির উৎস আরবি ভাষা থেকে। এর অর্থ গ্রন্থাগার, পাঠশালা। ইসলামি পরিভাষায়, মুসলিম শিশুদের ইসলামি শিক্ষায় মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা কেন্দ্রই মক্তব। যেখানে কোমলমতি শিশুদের কুরআন-হাদিস শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মাসয়ালা, দোয়া-দরুদ, ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা ও নৈতিক শিক্ষা দেয়া হয়। মক্তব শিক্ষা সর্বযুগে সবার জন্য উন্মুক্ত । ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য মক্তবই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর জীবনের প্রথম পাঠশালা।

            রাসূল (সা.)- এর পরবর্তী সাহাবী, তাবেয়ী, তাবে-তাবেঈন যুগে মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে ইসলাম সর্বপ্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে আসে। পরবর্তীতে ৭১১ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের ফলে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রসিদ্ধি লাভ করে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর পরই মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষায় ভারতবর্ষে মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয়। সিন্ধু বিজয়ের হাত ধরে ভারতে মাদ্রাসা শিক্ষা বা ইসলামী শিক্ষার যাত্রা শুরু হলেও প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এরও বেশ কিছুকাল পর। মুহাম্মদ ঘুরী ১২০০ শতকের শেষদিকে ভারতে তুর্কি সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১১৯১ সালে তিনি আজমীরে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর আধিক্যতা এবং মাদ্রাসা সল্পতায় একপর্যায়ে মসজিদ ভিত্তিক মক্তব শিক্ষা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। যার ফলশ্রæতিতে মাদ্রাসায় অধ্যয়ন না করেও ধর্মীয় জ্ঞান, নৈতিক শিক্ষা অর্জন করা সহজ হয়ে উঠে। কালক্রমে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সকল শহর, গ্রাম, মহল্লার মসজিদগুলোতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতিতে জ্ঞান অর্জন করা শুরু করে। কিন্তু দুঃখের কথা হলো, বিশেষ করে এই শতকের শুরুর দিক থেকে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে মক্তব শিক্ষা হারিয়ে যেতে বসেছে। ভোরবেলায় শিশুদের মক্তবে যাওয়ার চিরাচরিত দৃশ্য এখন আর গ্রামবাংলায় খুব একটা চোখে পড়ে না। মসজিদের বারান্দাগুলো কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ শরিফ, হামদ-নাত- এর মিষ্টি মধুর সুরে মুখরিত হয় না। শোনা যায় না সম্মিলিত কন্ঠে সকালে কোরআনের আওয়াজ। কোথাও কোথাও চালু থাকলেও সেখানে এখন ছাত্র-ছাত্রীর সংকট।

            এই মক্তব শিক্ষা ব্যবস্থার বর্তমান বেহাল দশার জন্য প্রধান কারণ হলো অবিভাবকদের উদাসীনতা। বর্তমান প্রচলিত প্রভাতী স্কুল, কিন্ডারগার্ডেনও সমভাবে দায়ী। যেখানে খুব ভোরে শিশুদের এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়, অথচ এই সময়টা মক্তব শিক্ষার জন্য উৎকৃষ্ট সময় ছিলো। যদিও এসব প্রতিষ্ঠানে নাম মাত্র ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়, তবুও এটা যথেষ্ট নয়।

            শহরের সাজসজ্জা সম্বলিত মসজিদগুলোতে ‘বাচ্চারা মসজিদের আগমনে মসজিদ অপরিষ্কার এবং সাজসজ্জার নষ্ট হবে’ এই ধারণার কারণে মক্তব শিক্ষা প্রায় বন্ধ। জাগতিক শিক্ষাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষাকে মূলধারার বাইরে মনে করে অনেক অবিভাবকরাই বাচ্চাদের ধর্মীয় শিক্ষা বিমুখ করে তুলছে। যার ধারাবাহিকতায় নতুন এক প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে যারা মক্তবের যে শিক্ষা, কোরআন ও হাদিসের পাঠদানের পাশাপাশি ইবাদত-বন্দেগি, অজু, গোসল, নামাজ, রোজাসহ এসব বিষয়ে অপারগ।

            বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল-কলেজ থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ ছেলে মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করছে এটা ঠিক। কিন্তু আমরা যদি চিত্রের উল্টো পৃষ্ঠের বিষয়টি একটু খেয়াল করি তাহলে দেখতে পাবো ওইসব জিপিএ-৫ পাওয়া ছেলে-মেয়েরা ইসলামি জ্ঞান ও নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে যথেষ্ট উত্তীর্ণ নয়। এটা দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। সত্যিকার অর্থে একটি একটি আদর্শ জাতি গঠন করতে চাইলে মক্তবশিক্ষার প্রসার রাষ্ট্রীয়ভাবে বাড়ানো জরুরি। নাহলে এই শিক্ষা ব্যবস্থা শীঘ্রই হারিয়ে যেতে পারে।

Share This

COMMENTS