এসএমই খাতকে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিতে রূপান্তরের উদ্যোগ


দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাতকে জাতীয় অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পর পর চারটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছে বিনিয়োগ সমন্বয় কমিটি। এসব বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত ও কমিটির চেয়ারম্যান লুৎফে সিদ্দিকী। উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ. মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানসহ সরকারি ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা।
বৈঠকগুলোতে এসএমই খাতকে অর্থনীতির মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় উদ্যোক্তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
✅ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত সিদ্ধান্তসমূহ
১. বৈদেশিক অর্ডার থেকে প্রাপ্ত অর্থের ১০% ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখার নিয়ম বাতিলের উদ্যোগ।
২. এসএমই প্রতিষ্ঠানের জন্য বছরে ন্যূনতম ৩,০০০ মার্কিন ডলারের পৃথক বৈদেশিক মুদ্রা কোটা বরাদ্দের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ।
🏛 ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত বৈঠকের চারটি নতুন সিদ্ধান্ত
১. নতুন ফিনান্সিয়াল প্রোডাক্ট ডিজাইন: এসএমই ফাউন্ডেশন ও এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট (এসএমইএসপিডি) যৌথভাবে এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য উপযোগী চলতি মূলধন ও এসএমই-বান্ধব পণ্য ডিজাইনে উদ্যোগ নেবে।
২. নীতিমালার কার্যকারিতা যাচাই: এসএমইএসপিডি কর্তৃক জারি করা মাস্টার সার্কুলারের পারফরম্যান্স ইভ্যালুয়েশনের মাধ্যমে কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা হবে।
৩. ট্রেড লাইসেন্সবিহীন ঋণ: ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ প্রদানের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে এসএমইএসপিডি একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করবে।
৪. সুদের হার পুনর্বিবেচনা: রিফাইন্যান্সিং স্কিমকে আরও আকর্ষণীয় করতে গ্রাহক পর্যায়ের সুদের হার সমন্বয়ের বিষয়ে মতামত প্রদান করবে এসএমইএসপিডি।
এর আগে, ২৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পেমেন্ট, কাস্টমস, লাইসেন্স ও ঋণ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। পরে ২১ সেপ্টেম্বর এসএমই ফাউন্ডেশনে উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তাব শুনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে নীতিগত সুপারিশ পাঠানো হয়।
💻 অনলাইন বৈঠক (৮ অক্টোবর ২০২৫)
দেশের বিভিন্ন জেলার এসএমই উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত অনলাইন বৈঠকে প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনা পর্যালোচনা ও বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।
🔄 বাস্তবায়নাধীন সিদ্ধান্তসমূহ
১. স্যাম্পল ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া দ্রুত করতে এনবিআরের মনিটরিং জোরদার।
২. ডিজিটাল ওয়ালেটের মাধ্যমে অর্থপ্রাপ্তিতে আইসিটি খাতের মতো সুবিধা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা সংশোধনের উদ্যোগ।
৩. অনলাইন বিক্রির অর্থ দ্রুত উদ্যোক্তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা নিশ্চিত করতে SSL Commerce ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকসমূহকে নির্দেশনা।
৪. অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে রপ্তানিতে B2B ও B2C মডেল অন্তর্ভুক্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ।
৫. এসএমই নীতিমালা প্রচারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু।
৬. উদ্যোক্তাদের জন্য এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বিশেষ Foreign Currency / Endorsement Card চালুর প্রস্তাব।
৭. আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের জন্য এসএমই খাত সম্পর্কিত রিপোর্ট প্রকাশে বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের উদ্যোগ।
৮. রপ্তানি বৃদ্ধিতে বিদেশস্থ দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে Standard Operating Procedure (SOP) বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয়।
৯. এগ্রো-অর্গানিক সার্টিফিকেট ইস্যু সমস্যার সমাধানে এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিডার মধ্যে আলোচনা।
১০. ব্যাংক গ্যারান্টি ছাড়া আগাম পেমেন্ট সীমা ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ মার্কিন ডলার এবং ইআরকিউ (ERQ) অ্যাকাউন্ট থেকে পরিশোধ সীমা ২৫,০০০ থেকে ৫০,০০০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ। (সূত্র: FE Circular No. 35, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫)
১১. স্থানীয় বীমা কভারেজসহ ওপেন অ্যাকাউন্টে রপ্তানির অনুমোদন। (সূত্র: FE Circular No. 39, ০৫ অক্টোবর ২০২৫)
১২. ব্যবসায়ীদের সুবিধার্থে ট্রেড পেমেন্ট প্রক্রিয়ার ফ্লোচার্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশের উদ্যোগ।
অতিরিক্তভাবে, ২৮ আগস্টের বৈঠকে এনবিআর সিদ্ধান্ত নেয়— এখন থেকে ৮ ডিজিটের HS Code-এর প্রথম ৪ ডিজিট মিললেই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়ন সম্পন্ন করবে।
💬 বিশেষ দূতের বক্তব্য
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, “এই সংস্কারের মূল লক্ষ্য অর্থনীতিতে গতি আনা। এসএমই খাত আমাদের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি, কিন্তু তাদের কণ্ঠ বড় ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মতো জোরালো নয়। তাই আমাদের উচিত তাদের গতিশীলতা বাড়াতে সহায়তা করা—অর্থায়ন, পেমেন্ট ও লজিস্টিকসের প্রতিটি ধাপে সরকারকে সহায়ক হতে হবে, প্রতিবন্ধক নয়।”
