প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহ’র শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা
নুরুদ্দীন তাসলিম\ টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে দাওয়াতে তাবলীগের শীর্ষ মুরব্বিদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ান, মুসল্লিদের নফল নামাজ, তাসবিহ-তাহলিল এবং জিকির-আসকার শেষে লাখো লাখো ধর্মপ্রাণ মুসল্লির অংশগ্রহণে গত রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্তি ঘটলো ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।
আখেরি মোনাজাতে সমগ্র মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহ ও পরকালীন কল্যাণ এবং দ্বীনের দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। এ সময় শিশু, কিশোর, যুবক, যুবা, বৃদ্ধ বনিতা সকলেই জীবনের সকল পাপ পঙ্কিলতা থেকে মুক্তির জন্য মহান আল্লাহর দরবারে চোখের অশ্রæ ফেলে কায়মনোবাক্যে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মোনাজাত পরিচালনা করেছেন কাকরাইল জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব হাফেজ মাওলানা জোবায়ের আহমেদ।
টঙ্গীর তুরাগ তীরে অনুষ্ঠিত এই বিশ্ব ইজতেমাকে বলা হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম গণজমায়েত। প্রতি বছর ইজতেমাকে ঘিরে ধর্মীয় আবহ তৈরি হয় তুরাগের আশপাশের এলাকায়ও। মূলত: ইসলামপ্রিয় মানুষদের এই আগমনকে ঘিরে কিছু কিছু মানুষের মাঝে ছড়িয়ে আছে ভুল ধারণা। যেসব ধারণার সঙ্গে তাবলিগ সংশ্লিষ্টদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের কেউ এমন ধারণা পোষণ করেন না। সেহেতু এখানে বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে প্রচলিত এসব কিছু ভুল ধারণা ইত্যাদি বিষয়ে কতেক আলেম ও তাবলিগ সংশ্লিষ্টদের মতামত তুলে ধরা হলো:
এ সম্পর্কে অনেকে ধারণা করে থাকেন যে, বিশ্ব ইজতেমা “গরিবের হজ।” কেউ কেউ আবার মনে করেন, তিন বার বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেয়া একটি হজের সমান। আসলে এমন ধারণা পুরোপুরি অমুলক এবং এর কোনো ভিত্তি নেই। এমন ভাবাও ঠিক নয়। কারণ, হজ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধান। হজ ফরজ করা হয়েছিল নবীজির জীবদ্দশায়।
হজ ফরজের বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন,
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا
এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ। (সূরা আল ইমরান, (৩), আয়াত, ৯৭) । এই আয়াতে কারিমা নবম হিজরীর শেষ দিকে নাজিল হয়েছে।
বিপরীতে তাবলীগ জামাতের প্রচলন হয়েছিল গত শতাব্দিতে। আর টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা শুরু হয় ১৯৬৬ সালে, যা ইসলামের ফরজ, সুন্নত কিংবা মুস্তাহাব কোনো বিধান নয়। বরং বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিয়ে তাবলিগের সাথীরা ঈমান আমল সম্পর্কিত বয়ান শোনেন এবং কীভাবে তাবলিগের কাজ করবেন এ সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে থাকেন।
আর বিশ্ব ইজতেমা নিয়ে প্রচলিত এইসব ধারণা কীভাবে ছড়িয়েছে তার কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় না। তাবলিগ বা ইজতেমা সংশ্লিষ্টদের কেউ এমন ধারণা পোষণ করেন না। তারা বরাবরই এসব ধারণা থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়ে থাকেন বলে মন্তব্য করেছেন আলেম লেখক, রাজধানীর জামিয়া ইউসুফ বানুরীর মুহতামিম ও মাহমুদ নগর জামে মসজিদের খতিব মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ।
তিনি বলেন, মূলত: ‘মানুষকে ইসলামের সঙ্গে সহজে সম্পৃক্ত করার আধুনিক রূপ’। তিনি আরো বলেছেন, তাবলিগ একটি আরবি শব্দ। ইসলামের শুরুর যুগ থেকে রাসূলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে-তাবেয়িগণ তাবলিগের কাজ করেছেন।
সাধারণ মানুষকে দ্বীন এবং ইসলামের সঙ্গে সহজে সম্পৃক্ত করার একটি সহজ ও আধুনিক রূপ বের করেছেন হজরতজি ইলিয়াস রহিমাহুল্লাহ। তার ইন্তেকালের পর যে হজরতজিগণ এর দায়িত্ব পালন করেছেন তারা বা বর্তমান শূরার মুরব্বি আলেমদের কেউ কখনো তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমাকে গরিবের হজ বলেননি এবং তারা এমন কোনো ধারণা পোষণ করেন না।
‘হজের সঙ্গে অন্য আমলের তুলনা নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, হজ ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির অন্যতম একটি, এর সঙ্গে অন্য কোনো আমল বা ইবাদতের তুলনা নেই।
মুসলিম শরিফের ১৩৫ নম্বর হাদিসের উদ্ধুতি দিয়ে তিনি আরো বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কোন আমলটি সব থেকে উত্তম। তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর ওপর ঈমান। এরপর কোন আমল জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ। এরপর কোন আমল উত্তম জানতে চাইলে তিনি বলেন, হজ্জে মাবরুর।
হজের নির্দিষ্ট সংজ্ঞা এবং পরিভাষা আছে, এর কোনো কিছুর উপস্থিতি নেই এখানে। তাই ইজতেমাকে হজের সঙ্গে মেলানো ইসলামি আকিদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে ইজতেমা সংশ্লিষ্ট কেউ এমন ধারণা রাখেন না।
বিশ্ব ইজতেমার সময় তুরাগ তীরে দেশের বৃহত্তম জুমার নামাজ আদায় হয়। এতে কয়েক লাখ মুসল্লি অংশ নিয়ে থাকেন। দেশ-বিদেশের বরেণ্য আলেম, বুজুর্গ ব্যক্তিরা জুমায় অংশ নেন। এ কারণে অনেকে এ জুমাকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ মনে করেন এবং এতে অংশ নিলে আল্লাহ তায়ালা সবার গুনাহ মাফ করে দেন- এমন ধারণা করে থাকেন কেউ কেউ। মাওলানা আতাউল করিম মাকসুদ বলেন, ইজতেমার সময়ের জুমার নামাজকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণ বা আখেরি মোনাজাতকে বিশেষ মোনাজাতের অংশ মনে করেন না তাবলিগের কোনো মুরব্বি।
তারমতে, এখানে যেহেতু বৃহত্তম জুমা অনুষ্ঠিত হয় এবং বড় দোয়ার আয়োজন হয়ে থাকে, তাই আল্লাহর প্রিয় কোনো বান্দার উসিলায় দোয়া এবং নামাজ কবুলের সম্ভবনা রয়েছে।
তাছাড়া, তাবলিগে বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটে আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে। তাবলিগের সাথী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাধারণ মুসলমানেরা এতে অংশ নেন। আখেরি মোনাজাতের আগের রাত থেকেই ইজতেমার আশপাশের এলাকায় ভরে যায় মানুষজনের আগমনে। তিল ঠাই থাকে না। কারো কারো ধারণা, এখানে এসে দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই সেই দোয়া কবুল করেন, ফিরিয়ে দেন না।
এ বিষয়ে মুফতি আতাউল করিম মাকসুদের মতামত হলো: অনেক মানুষ একসঙ্গে দোয়া করলে এবং দোয়াতে বয়স্ক মানুষ, আলেম, বুজুর্গ ব্যক্তিরা একত্রিত হলে আল্লাহ কারো উসিলায় সেই দোয়া কবুল করবেন- এমন আশা রাখা যায়, তবে দোয়া ফিরিয়ে দেবেন এমন ধারণা ঠিক নয়।
‘আমলের ফজিলত সাব্যস্ত করার জন্য রাসূলের নির্দেশনা থাকা চাই’ এমন প্রসঙ্গে মুফতি আতাউল করিম মাকসুদ বলেন, বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হচ্ছে গত ৬০ বছর ধরে। আর যেকোনো আমলের ফজিলত সাব্যসস্ত করার জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাসের হাদিস ও নির্দেশনা থাকা জরুরি। আল্লাহর রাসূলের নির্দেশনা এবং হাদিসের বর্ণনা ছাড়া বিশেষ কোনো আমলের ফজিলত সাব্যস্ত করার অধিকার কারো নেই। তাই ৬০ বছর আগে চালু হওয়া বিশ্ব ইজতেমা, ইজতেমার বৃহত্তম জুমা এবং আখেরি মোনাজাতকে ফজিলতপূর্ণ মনে করা যাবে না।