আল্লাহ’র ঘর মসজিদে যাওয়ার আদব ও শিষ্টাচার
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা\ মহান আল্লাহর নবীদের মতো মুমিনগনও যুগে যুগে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য মসজিদ নির্মান করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللهِ مَنْ آمَنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللهَ فَعَسَى أُولَئِكَ أَنْ يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِيْنَ-
অর্থাৎ “আল্লাহর মসজিদসমুহ কেবল তারাই আবাদ করে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে। যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করে না। নিশ্চয়ই তারা সুনাম প্রাপ্তদের অন্তর্ভ‚ক্ত হবে।”
মুলতঃ মসজিদ আল্লাহর ঘর, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। মসজিদ মুমিনের প্রিয় আশ্রয়। মসজিদকে কেন্দ্র করেই মুসলমানের সামাজিক সম্পর্ক টিকে থাকে, দৃঢ় হয় মুসলিম ভ্রাতৃত্ব। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে মসজিদের মর্যাদা, আদব ও শিষ্টাচার বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে।
আল্লাহর ঘর মসজিদে যাওয়া এবং সেখানে অবস্থান করার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। যেমন-
১. আল্লাহর মেহমান : মসজিদ আল্লাহর ঘর। আর মসজিদে গমনকারী আল্লাহর মেহমান। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার বাড়িতে সুন্দরভাবে অজু করল এবং মসজিদে গমন করল, সে আল্লাহর অতিথি। আর মেজবানের জন্য অতিথির সম্মান করা আবশ্যক।’ (আত-তারগিব ওয়াত-তারহিব : ১/২১৪)
২. সর্বোত্তম স্থান : পৃথিবীতে সবচেয়ে উত্তম স্থান মসজিদ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে মন্দ স্থান বাজার এবং সবচেয়ে উত্তম স্থান মসজিদ।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস : ৭৪১)
৩. আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকা : যারা ভালোবাসা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পবিত্র অবস্থায় মসজিদে যায় আল্লাহ তার জীবন-জীবিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
নবীজি (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির প্রত্যেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর দায়িত্বে থাকে। সে বেঁচে থাকলে আল্লাহই তার জন্য যথেষ্ট এবং মারা গেলে বেহেশতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি নিজের ঘরে সালাম দিয়ে প্রবেশ করে তার জন্য মহামহিম আল্লাহ জামিন হন। যে ব্যক্তি মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলো তার জন্যও আল্লাহ জামিন হন। যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে (জিহাদে) রওনা হলো তার জন্যও আল্লাহ জামিন হন। ’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১১০৪)
৪. ইবাদতের স্থান : মসজিদ মুমিনের ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর জিকির করার স্থান। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যেসব ঘরে যাকে সমুন্নত করতে এবং যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩৬)
৫. হিদায়াতের উৎস : মসজিদ আসমানি হিদায়াত লাভের অন্যতম উৎস। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারাই আল্লাহর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে, যারা ঈমান আনে আল্লাহ ও আখিরাতে, নামাজ আদায় করে এবং জাকাত দেয়, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অতএব আশা করা যায়, তারা হবে সৎপথপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১৮)
৬. গুনাহ মাফ : উত্তমভাবে অজু করে মসজিদে গমন করলে আল্লাহ প্রতি কদমে গুনাহ মাফ করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি সুন্দরভাবে অজু করল, তারপর নামাজের (মসজিদ) উদ্দেশ্যে বের হলো। কেবল নামাজই তাকে বের করল বা তাকে উঠিয়েছে, তার প্রতি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ তার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন অথবা একটি করে গুনাহ মাফ করবেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৬০৩)
৭. কিয়ামতের দিন আলো লাভ : যারা অন্ধকার উপেক্ষা করে মসজিদে যাবে তারা পরকালে আলো লাভ করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যারা অন্ধকার রাতে মসজিদে যাতায়াত করে তাদেরকে কিয়ামতের দিন পূর্ণ জ্যোতির সুসংবাদ দাও।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫৬১)
আল্লাহর ঘর মসজিদের কিছু আদব ও শিষ্টাচার রয়েছে। যেমন-
১. পরিপাটি হয়ে যাওয়া : মসজিদে পরিপাটি হয়ে উত্তম পোশাক পরিধান করে যাওয়া মুস্তাহাব। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে বনি আদম! প্রত্যেক নামাজের সময় তোমরা সুন্দর পোশাক পরিধান করো।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা সচরাচর পরিহিত কাপড় ছাড়া যদি জুমার দিনে পরার জন্য পৃথক একজোড়া কাপড় সংগ্রহ করতে পারো, তবে তা-ই করো।’ (সুরা : আবি দাউদ, হাদিস : ১০৭৮)
২. হেঁটে মসজিদে যাওয়া : সুযোগ থাকলে পায়ে হেঁটে মসজিদে যাওয়া উত্তম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি কি তোমাদের বলব না, আল্লাহ তাআলা কী দিয়ে গুনাহ মুছে দেন এবং মর্যাদা বাড়িয়ে দেন? সাহাবারা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! হ্যাঁ (বলে দিন)। তিনি বললেন, কষ্ট থাকার পরও ভালোভাবে অজু করা, মসজিদের দিকে বেশি কদম ফেলে যাওয়া এবং এক নামাজ শেষ করে পরবর্তী নামাজের জন্য অপেক্ষা করা। আর এটাই হলো ‘রিবাত’ (প্রস্তুতি)। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৫১)
৩. ধীরস্থিরতার সঙ্গে মসজিদে যাওয়া : মসজিদে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে যাওয়া। তাড়াহুড়া না করা। নবীজি (সা.) বলেছেন, যখন সালাত শুরু হয়, তখন দৌড়ে গিয়ে সালাতে যোগদান করবে না, বরং হেঁঁটে গিয়ে নামাজে যোগদান করবে। সালাতে ধীরস্থিরভাবে যাওয়া তোমাদের জন্য অপরিহার্য। কাজেই জামাতের সঙ্গে সালাত যতটুকু পাবে আদায় করবে, আর যা ছুটে যায় পরে তা পূর্ণ করে নেবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯০৮)
৪. প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় দোয়া পড়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন এই দোয়া পড়ে- উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাফতাহলি আবওয়াবা রহমাতিক, অর্থ : হে আল্লাহ! আমার জন্য আপনার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করুন। তিনি আরো বলেন, আর (যখন কেউ) মসজিদ থেকে বের হয় সে যেন পাঠ করে- উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিন ফাদলিক, অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬৫২)
৫. দুই রাকাত নামাজ পড়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন মসজিদে প্রবেশ করে সে যেন দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর বসে। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৭১৪)
৬. দুনিয়াবি কাজে লিপ্ত না থাকা : মসজিদে আসার পর ইবাদত-বন্দেগিকে প্রাধান্য দেবে এবং জাগতিক কাজ পরিহার করবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন তোমরা মসজিদে কাউকে ক্রয় বা বিক্রয় করতে দেখবে, তখন বলবে, আল্লাহ তোমার ব্যবসাকে লাভজনক না করুক।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৩২১)
৭. কণ্ঠ উঁচু না করা : মসজিদে আওয়াজ উঁচু করা শিষ্টাচারবহির্ভূত। কেননা হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় সাহাবিদের উচ্চৈঃস্বরে কিরাত পড়তে শুনে পর্দা সরিয়ে বললেন, জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় রবের সঙ্গে চুপিসারে আলাপে রত আছ। কাজেই তোমরা পরস্পরকে কষ্ট দিয়ো না এবং পরস্পরের সামনে কিরাতে বা নামাজে আওয়াজ উঁচু কোরো না। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৩৩২)
আল্লাহ সবাইকে মসজিদের শিষ্টাচার রক্ষার তাওফিক দিন, আমিন।