লাকসাম-চৌমুহনী ৬০ কি.মি বেরুলা খাল জবরদখলে পুনঃখননের দাবীতে সর্বশ্রেণীর মানুষের মানববন্ধন
হুমায়ুন কবির মানিক\ বন্যার পানি নামছেনা, পানিবন্দি মানুষের হাহাকার! জলাবদ্ধতা নিরসন, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং খাল পুনঃখননের দাবিতে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী। গত বুধবার (১১ই সেপ্টেম্বর) সকালে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের নাথেরপেটুয়া বাজারে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে এলাকার ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেণী পেশার শত শত মানুষ মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন।
মানববন্ধনে বক্তারা উল্লেখ করেন, লাকসাম পৌর এলাকার ফতেপুর থেকে শুরু হয়ে নোয়াখালীর চৌমুহনী পর্যন্ত দীর্ঘ ৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বেরুলা খালসহ বিগত দেড় দশকে এ অঞ্চলের প্রায় সবকটি খাল দখল করে অবৈধভাবে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, পুকুর, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দখলবাজি-টেন্ডারবাজি করে অনেকেই লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন। আর দুর্ভোগে পড়েছেন এলাকাবাসী। এথচ, এসব খাল দিয়ে যাতায়াতসহ বর্ষার পানি নিষ্কাশন আর শুস্ক মৌসুমে চাষাবাদে সেচ কাজ হতো। কিন্তু খালগুলো দখল হয়ে পড়ায় বন্যার পানি সরতে পারছেনা। এতে জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন লাখো মানুষ।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, অবৈধভাবে খাল দখল করে কেউ দোকান নির্মাণ করেছেন, কেউ পুকুরের সাথে একিভুত করে দখলে নিয়েছেন।
তিনি বলেন, অবৈধ দখলবাজির দিন শেষ। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচির অন্যতম একটি দফা ছিল খাল খনন কর্মসূচি। কিন্তু বিগত দিনে আওয়ামী লীগের লোকেরা দখলবাজি করে সকল খাল দখলে নিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। যারা খাল দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তিনি তাদেরকে এসব স্থাপনা নিজ দায়িত্বে সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে তিনি অন্তবর্তী সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
মনোহরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমির হাফেজ নুরুন্নবী বলেন, বিগত সরকারের সোনার ছেলেরা চর দখলের ন্যায় খালগুলো দখল করে নিয়েছে। দেশের অন্যান্য স্থানে বন্যা হয়, আবার ভাটার সাথে পানি নেমেও যায়। কিন্তু দীর্ঘ এক মাস হতে চলেছে এ অঞ্চলের পানি কমছে না। তিনি খালগুলো দখল মুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের নিজ দায়িত্বে স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেয়ার আহবান জানান। তা না হলে ছাত্র-জনতার রোষানলে এসব অবৈধ স্থাপনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে হুশিয়ারি দেন। এ বিষয়ে তিনি অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি চিকিৎসক সাহাবুদ্দিন হায়দার বলেন, সকল বৈষম্য দূর করতে হবে। যারা অবৈধভাবে খাল দখল করে রেখেছেন তাদেরকে নিজ হাতে, নিজ দায়িত্বে স্থাপনা সরিয়ে নেয়ার আহবান জানান। নতুবা এলাকাবাসী এসব স্থাপনা গুড়িয়ে দিবে।
উত্তর হাওলা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি জাফর ইকবাল বাচ্চু বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আমরা দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি। যারা খাল দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে তারা দেশের শত্রু, জাতির কলংক। এ অঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসনে অবিলম্বে এসব খাল দখলমুক্ত করতে হবে।
নাথেরপেটুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুবকর বলেন, এককালে এ খাল দিয়ে আমরা পালতোলা নৌকা নিয়ে যাতায়াত করতাম, মালামাল পরিবহন করতাম। এখান থেকে লাকসাম এবং চৌমুহনী অনায়াসে যাতায়াত করা যেত। এ খালে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু খালটি দখল হয়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়সহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। চলমান বন্যায় প্রায় একমাস এলাকার মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। পানি সরতে পারছে না। খালটি অবিলম্বে মুক্ত করা হোক। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমন্বয়ক আরিফুর রহমান বলেন, যেখানে সেখানে খালে বাঁধ দিয়ে, স্থাপনা নির্মাণ করে পানি প্রবাহ বন্ধ করা হয়েছে। অন্যান্য স্থানে পানি কমে গেছে। কিন্তু আমাদের এলাকার পানি কমছে না, কৃত্রিম এ জলাবদ্ধতা নিরসনে খালটি দখল মুক্ত করতে হবে।
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন, ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আব্দুল গোফরান ভুঁইয়া, ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন মাহমুদ লিটন, মিজানুর রহমান সবুজ, ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন, আরিফুল ইসলাম পরশ, আব্দুল মতিন মেম্বার, মোঃ কামাল হোসেন, ইমরান হোসেন মুন্না, রবিউল হোসেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমন্বয়ক নাইমুর রহমান, হাফেজ শরাফত করীম প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।
মূলত: কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলার খিলা ইউনিয়নে খিলা বাজারের অবস্থান। প্রাচীন কালের এই বাজারটির পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিলো শতবর্ষী এই বেরুলা খাল। যুগের পর যুগ ধরে মানুষের জন্য ছিলো কল্যাণকর এই খাল। কিন্তু সেই খালটি এখন পুরোপুরি অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বাজারের এক প্রান্ত থেকে ওপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে খালটি এরই মধ্যে পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে। খালের ওপর প্রভাবশালীদের কেউ নির্মাণ করেছেন টিনের দোকান ঘর। আবার কেউ আরসিসি পিলার খালের মধ্যে ঢালাই করে নির্মাণ করেছেন পাকা দোকান ঘরও। যেন এক অরাজকতার কারবার! বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা বলছেন- গত এক দশকের মধ্যে বাজারটিতে যেন খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলেছে। কিন্তু প্রতিটি দখলের সময়ই প্রশাসন ছিলেন নিশ্চুপ ভূমিকায়। সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাজারটির বুক চিরে গেছে চারলেনের কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটি। মহাসড়কের পূর্ব পাশে খালটির অবস্থান। এরই মধ্যে খালের ওপর প্রভাবশালীরা দেড় শতাধিক দোকান তুলেছেন। এসব দোকানে প্রভাবশালীদের কেউ নিজেরা ব্যবসা করছেন। আবার কেউ ভাড়ায় দিয়ে প্রতি মাসে টাকা তুলছেন। একের পর এক দখলের ফলে খালটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে কোথাও কোথাও খালটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আবার কোথাও কোথাও খালটি সরু ড্রেনে পরিণত হয়েছে। বাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খিলা বাজারটির প্রায় ৮০ শতাংশ পড়েছে মনোহরগঞ্জ উপজেলার অংশে। আর বাকি অংশ পড়েছে পাশের লাকসাম উপজেলায়। খাল দখল প্রসঙ্গে বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মো. খোরশেদ আলম বলেন, প্রশাসন বিষয়টির দিকে নজর দেয় না। যার কারণে আমরা বাঁধা দিলেও দলখকারীরা শোনে না। সরকার থেকে খালটি কোন প্রকার লিজও দেয়া হয়নি। এরপরও বাজারের উত্তর মাথা থেকে ও দক্ষিণ মাথা পর্যন্ত পুরো খালটিতেই অবৈধ দোকান ঘরের সারি দেখা যায়। প্রায় সময় দেখি খালের মধ্যে নতুন নতুন দোকান ঘর ওঠে। আমরা এসব বলে কী লাভ?
খিলা এলাকার কৃষক মাইনউদ্দিন বলেন, এক যুগ আগেও এই খালের পানি দিয়ে ইরি-বোরো আবাদ করেছি। এখন আর সেটি সম্ভব হয় না। পুরো খালটি দখল হয়ে গেছে। প্রশাসন কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় গত এক দশক ধরে খাল দখলের প্রতিযোগিতা চলেছে। এখন বাধ্য হয়ে আমরা পুকুর-ডোবা বা মাটির নিচের পানি (ভূগর্ভস্থ পানি) উত্তোলন করে চাষাবাদ করি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেরুলা খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। ডাকাতিয়া নদীর কুমিল্লার লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজারের দক্ষিণাংশের ফতেপুর গ্রামে এর উৎসমুখ। মিশেছে নোয়াখালীর চৌমুহনীতে গিয়ে সেখানকার আরেকটি খালে। শত বছরের প্রাচীন খালটি আগে থেকেই ভরাট করে আসছে প্রভাবশালীরা। গত কয়েক বছরে কুমিল্লা ও নোয়াখালীর বিভিন্ন অংশে খালটি দখল করে দোকান ও বাড়িও নির্মাণ করা হয়েছে। এতে কোথাও কোথাও খালটির আংশিক ভরাট করা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও পুরোপুরি দখল হয়ে গেছে। স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম বলেন, যেখানে খালটি ভরাট বন্ধ ও দখলমুক্ত করে পানির প্রবাহ বাড়ানোর কথা, সেখানে উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানও বিগত সময়ে খালটি দখল করেছে। বিশেষ করে কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কটির চার লেন প্রকল্প বাস্তবায়নে খালটি যেন ধ্বংসের প্রকল্প নেয়া হয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত সড়ক বর্ধিত করতে গিয়ে খালটির অধিকাংশ স্থান ভরাট করা হয়ে গেছে। এতে কোথাও খালটি ড্রেনে পরিণত হয়েছে, আবার কোথাও খালের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লাকসাম পৌরসভার দক্ষিণে বাতাবাড়িয়া ও ভাটিয়াভিটা এলাকায় গেলে এখন কেউ বলতে পারবে না এখানে আগে কোনো খাল ছিলো। এতে ওই এলাকার পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এলাকাবাসীর ভোগান্তির কোনো শেষ নেই। মনোহরগঞ্জের প্রবীণ ব্যক্তি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রাচীনকাল থেকে এই খালটি দিয়ে লাকসামের দৌলতগঞ্জ বাজার থেকে নৌকায় নোয়াখালীর চৌমুহনী বাজার পর্যন্ত মালপত্র আনা-নেয়া হতো। এক সময় এই খালে পাল তোলা নৌকায় বসে মাঝি মধুর কণ্ঠে সুরের মায়াজাল বুনতেন। খাল থেকে পানি নিতে আসা গাঁয়ের বধূরা ঘোমটা টেনে কান খাড়া করে শুনতেন সেই গান। খিলা বাজারের মতো এভাবে বিভিন্ন স্থানে দখল এবং অপরিকল্পিত সেতু-কালভার্ট নির্মাণে খালের নৌপথ বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় দেড় যুগ আগেই। তবে কয়েক বছর আগেও খালটির টলটলে পানিতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতেন স্থানীয় জেলেরা। সেই খাল এখন নামে আছে, বাস্তবে নেই। এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলেও খাল দখলকারীরা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর ভাড়াটিয়াদের ভাষ্য- তাঁরা খাল দখলের বিষয়ে জানেন না। টাকার বিনিময়ে দোকান ভাড়া নিয়েছেন। খালের উপর নির্মিত একটি দোকানে ফার্নিচার ব্যবসা করছেন মাসুদ আলম নামের এক ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, মাস দুয়েক আগে মাসিক চার হাজার টাকা ভাড়ায় দোকানটি নিয়েছি। দোকানটির মালিক লাকসামের রাজাপুর গ্রামের রহিম মিয়া। তিনি কীভাবে দোকান নির্মাণ করেছেন- সেটা আমি জানি না। আমি ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করছি।