বুধবার, ১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পেশাগত বৈচিত্র্য: ইসলামি দৃষ্টিকোণ

২২০ Views

\ আব্দুল্লাহ যোবায়ের \

            পৃথিবীতে আল্লাহ নানা ধরনের, নানা পেশার মানুষ সৃষ্টি করেছেন। সবার ভালো লাগাও সমান নয়। কারও কৃষিকাজ ভালো লাগে, আবার কারও সেই কৃষিপণ্য নিয়ে ব্যবসা করতে ভালো লাগে। কেউ ঘরবাড়ি বানানোর সরঞ্জাম তৈরী করেন, আবার কেউ ঘরবাড়ি বানান। কেউ খাবার রান্না করেন, আবার কেউ লাকড়ির যোগান দেন। এভাবে কত শ্রেণি-পেশার ব্যবস্থা যে আল্লাহ তায়ালা রেখেছেন, তা আসলে গুনে শেষ করা যাবে না।

            মূলতঃ মানুষের নানামুখি পেশার উপর ভিত্তি করেই প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত সমাজ ব্যবস্থা টিকে আছে। এজন্য মানুষের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা অত্যন্ত বেশি। যেমন কারও পৃথিবীতে জীবন কাটাতে হলে প্রথমেই তার একটি ঘর দরকার হবে। এখন ঘর বানাতে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন। তার খাবারেরও প্রয়োজন হবে। খাবারের মাছ-মাংসের জন্য তাকে অবশ্যই জেলে এবং রাখালের দ্বারপ্রান্ত হতে হবে। আবার ভাত অথবা রুটির জন্য কৃষকের দ্বারপ্রান্ত হতে হবে। শুধূ ঘর আর খাবারেই হবে না, তার জামা-কাপড় দরকার। এজন্য তাঁতশিল্পে দক্ষ মানুষ দরকার। অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা লাগবে। তখন একজন চিকিৎসকের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

            নবি-রাসুলগণ সমগ্র মানব জাতির আদর্শ। আমরা দেখতে পাই, তাঁরা সবাই নানা ধরনের পেশায় যুক্ত ছিলেন। যেমন আদম, শিস, ইউনুস ও ইয়াকুব (আ.) কৃষিকাজ করেছেন; ইবরাহিম, হুদ, সালিহ, শুয়ায়ব (আ.) পশুপালন করেছেন, দাউদ (আ.) কামারের কাজ করেছেন, নূহ ও যাকারিয়া (আ.) কাঠের কাজ করেছেন।  প্রত্যেক নবি-রাসুলই কোনো না কোনো হালাল পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন। আমাদেও মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শৈশবে কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মেষ চরিয়েছেন। যখন তিনি পরিণত বয়সে পৌঁছিয়েছেন, বাণিজ্যিক কাফেলা নিয়ে বিদেশে ব্যবসায়িক সফরে গিয়েছেন। আবু সাঈদ আল খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে উটকে খাদ্য দিতেন, ঘর ঝাড়– দিতেন, জুতো মেরামত দিতেন, কাপড়ে তালি দিতেন, ছাগলের দুধ দোয়াতেন, চাকরের সাথে খেতেন, সে ক্লান্ত হয়ে গেলে সাহায্য করতেন। বাজার থেকে পরিবারের কাছে জিনিসপত্র বয়ে নিতে তিনি লজ্জা পেতেন না। তিনি ধনী-গরীব সবার সাথে হাত মেলাতেন, আগে সালাম দিতেন, কোনো দাওয়াতকে অবজ্ঞা করতেন না, যদিও তা নিম্নমানের খেজুর হয়। তিনি যা পেতেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক, মহানুভব চরিত্রের, তাঁর সঙ্গ ছিল আনন্দদায়ক, তাঁর মুখমন্ডল ছিলো উজ্জ্বল, হাসি ছাড়া বেশী বেশী মুচকি হাসতেন।             তিনি ছিলেন কোনো ধরণের হীনতা ছাড়াই বিনয়ী এবং অপচয় ব্যতীত দানশীল। তাঁর হৃদয় ছিলো কোমল ও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য দয়াদ্র। তিনি কখনো পেটপুরে খাননি এবং লোভ নিয়ে হাত বাড়াননি।’

            মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সৃষ্টির সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তিনি অবলীলায় উপরোক্ত কাজগুলো করেছেন। এগুলোকে মানহানিকর বা তাঁর সুউচ্চ মর্যাদার সাথে অবমাননাকর বিবেচনা করেননি। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে যুগে যুগে মুসলিম মণীষীরা হালাল শ্রেণিপেশায় যুক্ত থেকেছেন। কোনো কাজকেই তারা ছোটো করে দেখেননি।

            কিন্তু বর্তমান যুগে আমরা ইসলামের শিক্ষা থেকে অনেকটাই সরে গিয়েছি এবং এতে আমাদের পরকালীন ক্ষতির পাশাপাশি জাগতিক ভিত্তিও নড়বড়ে হয়ে গেছে। পশুপালন, কৃষিকাজ, ছোটোখাটো ব্যবসা, দিনমজুরী- এসব বিষয়কে এখন সরকারী-বেসরকারী উচ্চ বেতনের চাকরির চেয়ে নিচু চোখে দেখা হয়। যেসব কাজ নবি-রাসুলগণ করে গেছেন, তা কি কখনও তুচ্ছ হতে পারে?

            বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন আল্লামা আযীযুর রহমান নেছারাবাদী রহ: (কায়েদ ছাহেব)। তিনি ছারছীনা দরবার শরীফের মাহফিলে প্রায়ই জুতো পালিশের দোকান দিতেন এবং নিজেই কিছু পয়সার বিনিময়ে জুতো পালিশ করতেন। অথচ তখন তিনি ছারছীনা দারুছুন্নাত আলিয়া মাদরাসারই ভাইস-প্রিন্সিপাল পদে কর্মরত ছিলেন। মাহফিলে আগত অতিথিদের মধ্যে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তিনি যে শ্রেষ্ঠতম ধনী ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এরপরও কোনো বৈধ পেশাকেই যে ছোট করে দেখতে নেই, সেটা বুঝানোর জন্য তিনি এমন করতেন। তাঁর ব্যক্তিগত রুমের সামনে সবসময় লেখা থাকতো-

‘ওগো মুসলমানের ছেলে,

কাজ করিলে মান যাবে তোর

কোন কিতাবে পেলে?’

            আমরা দেখি, একজন কিছুটা শিক্ষিত হলে এবং কিছু সার্টিফিকেট অর্জন করলেই একটি উচ্চ বেতনের চাকরি করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকেন। চাকরির পদসংখ্যা যেহেতু সীমিত, তাই চাকরিপ্রার্থীদের বেশিরভাগই আশানুরূপ চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগতে থাকেন। অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করে বছরের পর বছর ধরে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যান। অথচ সুযোগ থাকার পরও তারা অন্য কোনো পেশায় নিজেকে যুক্ত করার কথা চিন্তাও করেন না। এটাকে নিতান্তই মানহানিকর এবং উচ্চ শিক্ষার সাথে অসামঞ্জস্যশীল মনে করেন। অথচ পেশার সাথে একাডেমিক শিক্ষার সংযোগ যে থাকতেই হবে, তা তো নয়।

            পূর্বসুরী বিখ্যাত আলিমগণ, যাদের লেখা বই পড়ে আমরা শিক্ষালাভ করি, ডিগ্রি অর্জন করি, তাদের পেশাগত বৈচিত্র্য দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। তারা জ্ঞানার্জনের সময় জ্ঞানার্জন করেছেন, ছাত্রদের শিক্ষা দিয়েছেন, কালজয়ী সব বই লিখেছেন। কিন্তু যে পেশাই সহজ মনে হয়েছে, বেছে নিয়েছেন। সেটাকে তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখেননি।

            হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) নবি-রাসুলগণের পরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্ব। তিনি কাপড়ের ব্যবসা করেছেন। আলি (রা.) কখনও কখনও দিনমজুরি করেছেন। মুহাজির সাহাবিদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী এবং আনসার সাহাবিদের অধিকাংশ কৃষক ছিলেন। বিভিন্ন সাহাবিদের জীবনী পর্যালোচনা করলে পশুপালন, কৃষিকাজ, তাঁতের কাজ তথা বুননশিল্প, চামড়াজাত দ্রব্য তৈরী, খেজুর গাছের পাতা দিয়ে তোষক-বালিশ তৈরী, কাঠের আসবাবপত্র তৈরীর কাজ, কসাইয়ের কাজ, কামারের কাজ (তরবারী, তীর, বর্শা, হাড়ি-পাতিল, বর্ম-শিরস্ত্রাণ তৈরী), স্থানীয় বাজার ও দূরদেশে ব্যবসা, দোকানদারি, দিনমজুরীসহ নানামুখী পেশার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। একবার প্রখ্যাত তাবেঈ ইমাম ইবন সিরিনের কাছে এক লোক আসার পর তিনি বললেন, ‘তুমি ব্যবসা করো না কেন? আবু বকর কুরায়শদের (শ্রেষ্ঠ) ব্যবসায়ী ছিলেন।’ ইবন সিরিন (র.) এর নিজেরও ঘি-এর ব্যবসা ছিল।

            যেসকল মুসলিম মণীষীর কালজয়ী গ্রন্থ আজ পুরো পৃথিবীর মানুষ পড়ে থাকে, তাঁদের নামের শেষে যুক্ত পদবি তাঁদের নানামুখি পেশাকে নির্দেশ করে। যেমন:

১.    الآجري (আল আজুরি): পোড়া ইট কেনা-বেচার ব্যবসায়ী।

২.    الباقلاني (আল বাকিল্লানি): মটরশুঁটির ব্যবসায়ী।

৩.   التوحيدي (আত তাওহিদি): তাওহিদ জাতীয় খেজুরের ব্যবসায়ী।

৪.    الجصَّاص (আল জাস্সাস): দেয়াল প্ল­াস্টার, চুনকাম করা ইত্যাদির শ্রমিক।

৫.    الحاسب (আল হাসিব): গণিতে পারদর্শী ব্যক্তিত্ব।

৬.   القفَّال (আল কাফফাল): তালা তৈরী বা তালা মেরামতের শ্রমিক।

৭.    الخرَّاز (আল খাররায): জুতা মেরামতকারী ও মুচি।

৮.   الفرَّاء (আল ফাররা): পশুর লোমের ব্যবসায়ী।

৯.    القطعي (আল কিতঈ): টুকরো কাপড়ের ব্যবসায়ী।

১০.   القدوري (আল কুদুরি): হাড়ি-পাতিলের ব্যবসায়ী।

            বিশ্বখ্যাত আলিমদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো পেশায় যুক্ত ছিলেন। এসব পেশা থেকে যে আয় হতো, সেগুলো তারা জ্ঞানার্জন ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করতেন। ইমাম আবু হানিফা (র.) এর নিজের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। তাঁর কারখানা থেকে এমন বহুমূল্যের কাপড় উৎপন্ন হতো, যা অন্য কোথাও পাওয়া দুর্লভ ছিল। ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ তিনি ছাত্রদের পেছনে ব্যয় করতেন। ইমাম আবু ইউসুফ (র.) ইমাম আবু হানিফার অর্থসাহায্যে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ইসলামের খিদমতেও ইমাম আবু হানিফা বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন। ইমাম যায়দ ইবন আলি (র.) যখন আব্বাসীয়দের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তিনি একাই ১২,০০০ দিরহাম পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। ব্যক্তিগত ব্যবসা না থাকলে এমন বিপুল খিদমতের আঞ্জাম দেয়াটা সম্ভব হতো না।

            সুফি সাধকগণ দুনিয়াবিরাগের চর্চা করতেন। কিন্তু এরপরও তাঁরা ব্যবসা বাণিজ্য করেছেন, যাতে আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে যেন হাত পাততে না হয়। আবুল হুসাইন নুরি, জুনায়েদ বাগদাদী, সিররি আস সাকতি, ফরিদুদ্দীন আত্তার প্রমুখের বাজারে দোকান ছিল। সায়্যিদুত তাইফা বা সুফিদের সর্দার হিসেবে প্রসিদ্ধ জুনায়েদ বাগদাদী (র.) প্রতিদিন দোকানে ঢুকে পর্দা ঝুলিয়ে দিতেন এবং চারশ’ রাকাত নামায পড়তেন। এরপর বাড়ি ফিরে যেতেন। এছাড়া অনেক সুফি বিভিন্ন পেশায় নিজেদের যুক্ত রেখেছিলেন। যেমন ইবরাহিম ইবন আদহাম (র.) আঙুরের ক্ষেত পাহারা দিতেন। আবু হাফস আল হাদ্দাদ কামারের কাজ করতেন।

            দেখা যাচ্ছে, জগদ্বিখ্যাত ইমাম ও সুফিসাধকগণ কেউই হালাল পেশা থেকে দূরে থাকেননি। কোনো কাজকে ছোটো করেও দেখেননি। তাঁরা বিপুল পরিমাণ ধর্মীয় জ্ঞানের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও এই জ্ঞানকে কখনই অর্থ উপার্জনের মাধ্যম বানাননি। আমাদের বর্তমান সমাজচিত্র পুরোটাই উল্টে গিয়েছে। কোনো আলিম ধর্মীয় বক্তব্য রেখে, ধর্মকে পুঁজি করে অর্থ উপার্জন করলে আমরা তাকে বিরাট বড় আলিম মনে করে সমাদর করি এবং একই আলিম যদি বাজারে একটি দোকান দিয়ে বসেন, তাকে তাচ্ছিল্য করি। অথচ শেষোক্ত কাজটিই ছিল প্রকৃত সালাফদের অনুসরণ।

            বর্তমান যুগে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা অনৈক্য এবং এই অনৈক্যের পেছনে অন্যতম অনুঘটক হলো আর্থিক দীনতা। ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর পারস্পরিক দ্ব›েদ্বর পেছনে আমরা যতই ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাই না কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আর্থিক প্রাপ্তির বিষয়টি মুখ্য থাকে। তাই পেশাগত বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে আর্থিক অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারলে আমাদের মন-মানসিকতা যেমন উদার হবে, তেমনি অভ্যন্তরীন দ্ব›দ্ব-সংঘাত থেকেও আমরা অনেকাংশে মুক্ত থাকতে পারবো।

লেখক: প্রভাষক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Share This