
আমেরিকার স্কুল, গির্জা আর হাসপাতালেও চলবে অবৈধ অভিবাসী ধরপাকড় অভিযান

শহীদুল্লাহ ভূঁইয়া : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২০শে জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পর থেকেই বিভিন্ন রাজ্যে নথিপত্রহীন অবৈধ অভিবাসীদের ধারপাকড় অভিযান শুরু হয়ে গেছে। আর এমন অভিযান চলমান থাকবে আমেরিকার স্কুল, গির্জা আর হাসপাতালগুলোতেও। আর ট্রাম্প প্রশাসন সংবেদনশীল এই স্থানগুলোতে অভিবাসী আটক অভিযানের ওপর থেকে চলমান নিষেধাজ্ঞাটা বাতিল করে দিয়েছেন।

Courtesy: PBS News
এতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন কর্তৃপক্ষ এখন থেকে স্কুল, গির্জা এমনকি হাসপাতালগুলোতেও অভিবাসীদের গ্রেপ্তার করতে পারবেন। “Migrants can now be arrested at churches and schools after Trump administration throws out policies” By-Associated Press. যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সংবেদনশীল এই স্থানগুলোতে অভিবাসী আটক কার্যক্রমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করার পর এখন এই ধরপাকড়ে আর কোনও বাধা থাকেনি। এ প্রসঙ্গে, সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছেন যে, ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) এবং কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন সংস্থাগুলোর ওপর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এসব স্থানে অভিযান পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল। এখন তা উঠে যাওয়ার পর ওই দুই সংস্থা তদারককারী মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “অবৈধ অভিবাসী অপরাধীরা আর গ্রেপ্তার এড়াতে আমেরিকার স্কুল এবং গির্জাগুলোতে লুকিয়ে থাকতে পারবেন না।

Courtesy: Reuters
ট্রাম্প প্রশাসন আমাদের আইনপ্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের হাত আর বেঁধে রাখবেন না।” গত মঙ্গলবার হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি বেঞ্জামিন হাফম্যান এই সংবেদনশীল স্থানগুলো থেকে অভিবাসী গ্রেপ্তারের এই নির্দেশনাসহ আরও একটি নির্দেশনা জারি করেন। সেটি হচ্ছে, বৈধ কাগজপত্র না থাকা কেউ গ্রেপ্তার হলে সেই ব্যক্তি যদি যুক্তরাষ্ট্রে দুবছরের বেশি সময় ধরে তার অবস্থান প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তাকে দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দিতে পারবেন কর্তৃপক্ষ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণে কঠোর অভিযানের অংশ হিসেবে এই পরিবর্তনগুলো এনেছে। এছাড়া, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত সোমবার হোয়াইট হাউজে ফিরেই আরো একাধিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যার মধ্যে একটি অ্যাপ বন্ধের নির্দেশনাও রয়েছে।
এই অ্যাপের কারণে কয়েক হাজার মানুষ সহজে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারতেন। তাছাড়া, অ্যাপটি বন্ধ করা ছাড়াও শরণার্থী ব্যবস্থা স্থগিত করা এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) এর সঙ্গে স্থানীয় ও রাজ্য সরকারের সমন্বয় আরও জোরদার করার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘোষণা দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বাস করা লোকজনকে অবিলম্বেই ধরপাকড় করা শুরু হবে। প্রেসিডেন্টের গণহারে অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন কর্মসূচি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও জানান কর্মকর্তারা। তদুপরি, ট্রাম্পের সীমান্ত সম্রাট টম হোম্যান সোমবার সন্ধ্যায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “মঙ্গলবার থেকে অভিবাসন এজেন্টরা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এবং অনথিভুক্তদের গ্রেপ্তার ও বহিষ্কারের কাজ শুরু করবে।” অবশ্য, স্কুল, গির্জা আর হাসপাতালের মতো সংবেদনশীল স্থানগুলোতে গ্রেপ্তারের অনুমতি দেওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করেছেন মার্কিন আইনজীবীরা।
‘সেন্টার ফর ল অ্যান্ড সোশ্যাল পলিসি’ এক বিবৃতিতে বলেছে, “এ পদক্ষেপের কারণে অভিবাসীদের পরিবার ও তাদের সন্তানের পাশাপাশি মার্কিন শিশুরাও মারাত্মক মানসিক চাপের সম্মুখীন হতে পারে।” এর আগে, মঙ্গলবার ওয়াশিংটনের এক বিশেষজ্ঞ সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিবাসী এবং এলজিবিটিকিউ+ জনগোষ্ঠীর প্রতি এত কঠোর না হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন বলে খবর দিয়েছেন রয়টার্স। ওদিকে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে নথিপত্রহীন অভিবাসীদের ধারপাকড় অভিযান শুরু হয়ে গেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ইতোমধ্যে নিউইয়র্কের ব্রুকলিন বরোর ফুলটন এলাকা থেকেও ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস ইনফোর্সমেন্ট (আইস) বিভাগের সদস্যরা অন্তত: ৪ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছেন বলে জানা গেছে।এর ফলে দারুণ আতঙ্ক বিরাজ করছে কাগজপত্রহীন বাংলাদেশীদের মধ্যে। ওদিকে, গত সোমবার শপথ গ্রহণের পর থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার পর্যন্ত ২ দিনে অভিবাসন–সংক্রান্ত শতাধিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমলের ৭৮টি নির্বাহী আদেশ বাতিলসহ নতুন ৪৭টিতে স্বাক্ষর করেছেন তিনি। অবৈধ অভিবাসীদের শক্ত হাতে দমন করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। এতে করে পুরোদমে ধরপাকড় শুরু হচ্ছে আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে। নথিপত্রহীন সন্দেহভাজন অভিবাসীদের ব্যাপক মাত্রায় জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, ডোনাল্ড ট্রাম্প গত ২০শে জানুয়ারি ওয়াশিংটনে শপথ অনুষ্ঠানে আরও বলেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত অতিক্রম করে লাখ লাখ অনুপ্রবেশকারী নির্দ্বিধায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এভাবে সীমান্তে প্রবেশ করার তৎপরতা বন্ধ করা হবে। তারপর বের করে দেওয়া হবে অপরাধীদের। এই প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে মেক্সিকো সীমান্তে জরুরি অবস্থাও জারি করা হয়েছে। রাখা হচ্ছে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থা। এই আদেশের আওতায় অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়ার একটি প্রকল্পও বন্ধ করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত কর্তৃপক্ষ। অবৈধ অভিবাসী প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানাকে অ্যাটর্নি রাজু মহাজন বলেছেন যে, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বেশ কয়েকটি নির্বাহী আদেশে বাংলাদেশিরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।
যারা ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ দক্ষিণ আমেরিকার পথ ধরে মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে ঢুকতেন, সেই পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আগে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। সে হিসাবে অভিবাসীরা বিভিন্ন জায়গায় চাকরির ব্যাপক সুযোগ পেয়েছিলেন। এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে সেসব নিয়োগ নির্ধারিত হবে। ফলে ছাটাই হতে পারেন অসংখ্য বাংলাদেশি লোকজনও। এছাড়া, আরেকটি নির্বাহী আদেশ জারি করে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের একটি বিধানও বাতিল করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে করে এখন থেকে ৩০ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানেরা দেশটির নাগরিকত্ব পাবে না। তবে ইতিমধ্যে এই নির্বাহী আদেশের বিরুদ্ধে ২৪টি রাজ্য ও শহরে মামলা রুজু হয়ে গেছে। যেহেতু এটা মার্কিন সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনের বিরুদ্ধে যায়, সে কারণে হাইকোর্ট হয়তো এটি বাতিল করে দিতেও পারে। বলা বাহুল্য যে, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে ফিরিয়ে নিতেই সৃষ্টিকর্তা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ হার মানা যেন তাঁর স্বভাবে নেই। এ কারণে ৭৮ বছর বয়সী অদম্য ট্রাম্প ২০২০ সালের ভোটে হেরেও পরাজয় মানতে অস্বীকার করেছিলেন। সেখান থেকে বীরের বেশে ফিরে এসে এবার ২০২৫ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও তিনি ৪ বছরের জন্য হোয়াইট হাউসের বাসিন্দা হলেন এবং বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার হাতে নিলেন। ১টা নয়; ২টি বাইবেলে হাত রেখে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন এই বলিষ্ঠ সাহসী রিপাবলিকান নেতা।
শপথ নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্বর্ণযুগ’ শুরুর ঘোষণা দেন নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের গল্প তৈরি করা এই রাজনীতিক ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর এই যাত্রার মধ্য দিয়ে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়; আরেক ‘ট্রাম্প যুগে’ প্রবেশ করলো গোটা বিশ্বও। অথচ গল্পটা ভিন্নও হতে পারতো! কারণ বছরের পর বছর নানা বিতর্ক জন্ম দিয়ে রাজনীতি থেকে কিছুটা ছিটকে পড়ার ঝুঁকিতেও ছিলেন তিনি। অভিশংসিত হয়েছেন, একাধিক ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন, বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছেন, দোষী সাব্যস্তও হয়েছেন। এত কিছুর মধ্যে আততায়ীর বুলেট এড়িয়ে আমেরিকার ইতিহাসে সবাইকে তাক লাগিয়ে তিনি বীরদর্পেই ফের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন করেছেন। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর থেকে বিশ্বের পত্রপত্রিকায়ও নেগেটিভ/ বা পজিটিভ নানা ধরনের নিউজ ছাপা হচ্ছে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও। হেডিং হচ্ছে “যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও।” এটি দৈনিক সমকাল পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম। উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, উন্নত জীবনের আশায় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের অভিবাসন প্রত্যাশীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেই স্বপ্নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথগ্রহণের পর প্রথম দিনেই তিনি অভিবাসন নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সই করেছেন একাধিক নির্বাহী আদেশে।
এতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপের প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের ওপরেও। প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রভাব এবং পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চাওয়া বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা আরও যাচাই – বাছাইয়ের মুখোমুখি হতে পারেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন আরো কঠোর হবে বলে জানিয়েন রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির নিজেও। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যমকে আরো জানিয়েছেন যে, এখন পর্যন্ত পাওয়া সব তথ্য অনুযায়ী অভিবাসন নিয়ে মোট ৬/৭টি নির্বাহী আদেশ জারি হতে পারে! জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল বিষয়ক আদেশে ট্রাম্প সই করেছেন ইতিমধ্যেই। বাকিগুলো করেন কিনা- তা নিয়েও চলছে অনেক জল্পনা-কল্পনা। সে জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু সময় পর্যন্তও।