রবিবার, ২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শুভ বাংলা নববর্ষ সম্পাদকীয়

১১ Views

দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, মাসের পর মাস গড়িয়ে ফিরে আসে পহেলা বৈশাখ। বাঙলা নববর্ষ ১৪৩২। সব চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশা পেছনে ফেলে ১৪৩১ সাল কালের ¯্রােতে বিলীন হলো। ১৪৩২ সালের শুভাগমনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রভাতের সূচনা হলো গত ১৪ই এপ্রিল সোমবার। বাংলা নববর্ষকে আমরা স্বাগত জানাই। এটা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অচ্ছেদ্য অংশ। বলাবাহুল্য, বাংলা সন ও নববর্ষ উদযাপন মূলত মুসলিম ঐতিহ্যজাত এবং মুসলিম শাসকরাই তা প্রবর্তন করেন। বাংলা সনের সঙ্গে বাংলার শাসনব্যবস্থার সংস্কারে মুসলমান শাসকদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে। দিল্লি সালতানাতের সময়ে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হলেও কৃষিভিত্তিক সমাজবাস্তবতায় হিজরি বর্ষপঞ্জিতে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্য দেখা দেয়ায় বাংলার কৃষিভিত্তিক ঋতুচক্রের অনুসরণে একটি নতুন বর্ষপঞ্জির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুঘল স¤্রাট আকবর হিজরি সনের ভিত্তিতে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। মুঘল রাজদরবারের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ সিরাজী হিজরি সন ও সৌর সনের সমন্বয় করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। মুঘল আমলে প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাতে কিছু সংস্কার করেন। তার সংস্কার অনুসারে এখন প্রতিবছর ১৪ই এপ্রিলে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের উৎসব হয়ে থাকে। আমাদের রয়েছে একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার, যা জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ ও গর্বিত করেছে। এ কারণেই আমাদের জাতীয় জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি।

বাংলা নববর্ষ পালন এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে গ্রামীণ জনপদে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হালখাতা এবং কৃষকের ঘরে নতুন ফসল উঠার এ সময়ে নববর্ষ উদযাপনে বৈশাখী মেলা হয়ে উঠত সব বয়েসী মানুষের আনন্দ-উৎসব ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের নতুন উপল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ আবাহনে যে সব অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে তা অতীতে ছিল না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি ঢাকায় বাংলা নববর্ষ পালনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ হিন্দু ঐতিহ্য অনুসরণে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’য় রূপান্তরিত হয়। অতঃপর মুখে উল্কি আঁকা, বিভিন্ন জীবজন্ত বিশেষ করে হুতুম পেঁচা, হাতি, কুমির, সাপ, বিচ্ছু ও ঘোড়ার মুখোশ পরা, প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষদের একসঙ্গে অশালীন পোশাক পরে শোভাযাত্রা করা, শোভাযাত্রায় বাদ্য-বাজনার সঙ্গে আপত্তিজনক ভঙ্গিমায় নৃত্য করা ইত্যাদি মঙ্গল শোভাযাত্রার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এটা বিশেষ সম্প্রদায় বা গোষ্ঠির আচরিত সংস্কৃতি হতে পারে, তবে এদেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের জন্য এসব সংস্কৃতি নয়। এগুলো তাদের আচরিত সংস্কৃতির পরিপন্থী, ধর্মীয় মূল্যবোধের খেলাফ। সার্বজনীন সংস্কৃতির নামে এসব অনৈসলামিক আচারকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তক্রমে মঙ্গল শোভাযাত্রার স্থলে আনন্দ শোভাযাত্রা ফিরে এসেছে। এবার নববর্ষ পালনে ব্যাপক উদ্দীপনা পরিলতি হচ্ছে। এটা আনন্দের কথা। লক্ষ্য করার বিষয়, নববর্ষ পালনের সঙ্গে সঙ্গে চৈত্র সংক্রান্তি পালনের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২ দিন উৎসব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব বা পার্বণ।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মানুষের নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় চলছে। মাদক, যৌন হয়রানি, পারিবারিক কলহে খুন-জখম, হত্যা, ধর্ষণ, নৃশংসতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের মূলে রয়েছে, আমাদের নিজস্ব হাজার বছরের নীতি-নৈতিকতা, ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করা এবং এ সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়া, অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া। আমরা যতই উন্নয়ন করিনা কেন, যদি নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় চলতে থাকে, তবে তা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ চর্চার বিকল্প নেই। এদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। অতঃপর বাংলা নববর্ষে আমাদের লাকসামবার্তার সকল পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতা ও দেশবাসীকে আামরা আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

Share This

COMMENTS