বৃহস্পতিবার, ৮ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া কর্মকান্ডে জনমনে আতংক

কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের বেপরোয়া কর্মকান্ডে জনমনে আতংক
১৫ Views

            নিজস্ব প্রতিনিধি\ কুমিল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাদের বেপরোয়া কর্মকান্ডে আতঙ্ক বাড়ছে জনমনে। কয়েক দিন পর পর প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে নিজ নিজ গ্রæপের শক্তি জানান দিচ্ছে তারা। আধিপত্য নিয়ে বিরোধে প্রায়ই তারা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে।

            পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত আট বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত ১২টি খুনের ঘটনা ঘটে। নগরীতে বিভিন্ন নামে কিশোর গ্যাংয়ের অন্তত ২০টি গ্রæপ রয়েছে। গ্যাং লিডারদের নির্দেশে তারা মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। কয়েক দিন পর পর তারা মহড়া দিলে টনক নড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর।

            বিভিন্ন অভিযোগে কিশোর গ্যাংয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারও করা হয়। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধে জড়ায় তারা।

            সর্বশেষ গত ২৫শে এপ্রিল বিকেলে নগরীর রানীর দীঘিরপাড়, তালপুকুরপাড় ও আদালতপাড়া এলাকায় অস্ত্র নিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের তিনটি গ্রæপের তিন শতাধিক সদস্য মহড়া দেয়। এ ঘটনার পর আলোচিত কিশোর গ্যাং ‘র স্কোয়াড’ (রতন গ্রæপ) প্রধান ইমরান হোসেন ওরফে রতনসহ (১৯) মোট ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা।

            কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের দিকে কুমিল্লা নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। ‘র স্কোয়াড’ (রতন গ্রæপ), ইগল, র‌্যাক্স, এক্স, এলআরএন, এলক্স, কেডিজি, সিবিকে, বস, মডার্ন, রকস্টার, ডিস্কো বয়েজ, আইএনজিসহ বিভিন্ন নামে অন্তত ২০টি গ্রæপ রয়েছে। ২০১৭ সালের পর থেকে গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া শিশু-কিশোরদের হাতে অন্তত ১২টি হত্যাকান্ড ঘটেছে।

            খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লার অশোকতলা এলাকায় সজীব হোসেন ওরফে বাবু (২২) নামের এক তরুণকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে আহত করার পরদিন সকালে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।

পুলিশ বলছে, ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের মাদক ব্যবসা।

            নিহত সজীব দেবীদ্বার উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের মফিজুল ইসলামের ছেলে। তারা অশোকতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।

            একই বছরের ২রা ফেব্রæয়ারি নগরীর সবচেয়ে আলোচিত কিশোর গ্যাংয়ের দু’টি প ‘ইগল গ্রæপ’ ও ‘রতন গ্রæপ’ সদস্যদের মধ্যে সশস্ত্র মহড়া ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় উভয় পক্ষের সদস্যরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ঘটনায় দুই পক্ষের ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক মাস চুপচাপ থেকে এ দু’টি গ্যাং আবার বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

            একই বছরের ২৪শে মে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩৯ কিশোর গ্যাং সদস্যকে আটক করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। পরে রাতে অভিভাবকদের মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হয় তাদের। ১১ই অক্টোবর ছয়টি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা তানজিম আবদুল্লাহকে (২০) দেশি অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

            পুলিশ জানায়, তানজিম সিবিকে (কুমিল্লা ব্রাদার্স কমিউনিটি), সিবিকে ডেঞ্জার জোন, সিবিকে জুনিয়র, সিবিকে স্পেশালসহ ছয়টি গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।

            ২০২২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর রাতে নগরীর দক্ষিণ চর্থা বড়পুকুর পাড় এলাকায় ‘থার্টিফার্স্ট নাইটের পার্টি’ থেকে ডেকে নিয়ে ফয়সাল ইসলাম (১৯) নামের এক তরুণের হাত-পায়ের রগ কেটে এবং কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১৯শে আগস্ট নগর উদ্যানের সামনে শাহাদাত হোসেন নামের (১৫) এক কিশোরকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।

            ২০২১ সালের ৩০শে এপ্রিল কুমিল্লা ইপিজেডের একটি চীনা কম্পানির কর্মকর্তা খায়রুল বাশারকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইপিজেডের সামনে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা কিশোর গ্যাং ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছিল র‌্যাব। একই বছরের ২৬শে ফেব্রæয়ারি নগরীর ঠাকুরপাড়া এলাকার মোহাম্মদ আমিন (১৫) নামের এক কিশোরকে পিঠে ও বুকে ছুরিকাঘাতে খুন করে কিশোর গ্যাং।

            ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে তাদের গ্রæপ রয়েছে। এর মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করে তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।

            নাম প্রকাশ না করার শর্তে রতন গ্রæপের এক সদস্য দাবি করে, নগরীর সবচেয়ে বড় গ্রæপ তাদের। তাদের কারণে অশোকতলার বিসিকে, কেবিএস ও মোগলটুলীর ইগল গ্রæপ কোণঠাসা। মামলার কারণে রতন গ্যাংয়ের লিডার রতন ও সাইফুল পলাতক থাকায় গত ২৫শে এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে অশোকতলার সিবিকে ও কেবিএস এক হয়ে নিজেদের শক্তির মহড়া দেয়।

            সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) কুমিল্লার সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পুলিশের। পুলিশ যদি চায় খুব দ্রæত সময়ের মধ্যে এসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের শনাক্ত করে নির্মূল করা সম্ভব।

            কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ মোল্লা টিপু বলেন, নগরীতে কিশোর গ্যাং আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ¤ø­ান করতে তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। প্রশাসনের কাছে অনুরোধ থাকবে, অপরাধী যেই হোক, তাকে দ্রæত গ্রেপ্তার করা হোক।

            কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মহিনুল ইসলাম বলেন, পুলিশ সুপারের নির্দেশে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বন্ধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ২৫শে এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে।

Share This