দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে


কৃষিবিদ মোহাম্মদ সামছুল আলম\ বাংলাদেশের মৎস্য খাত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ খাত শুধু দেশের খাদ্য চাহিদাই মেটাচ্ছে না, আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বিশেষ অবদান রাখছে। দেশে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ উভয়ই রয়েছে। এ খাত সবচেয়ে উৎপাদনশীল ও গতিশীল খাতগুলোর একটি হওয়ায় কয়েক দশক ধরে অর্থনীতিতে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এ খাত দেশের কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নে সম্ভাবনার দাবি রাখে। মৎস্য খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২.৫৩ শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (বিবিএস ২০২৪) সামগ্রিক কৃষি খাতে এ খাতের অবদান ২২.২৬ শতাংশ। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ১২ শতাংশ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য মৎস্য খাতের অধীনে বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিযুক্ত।
বর্তমানে নিরাপদ মাছ উৎপাদন ও দেশীয় মাছ রক্ষা করে এর সরবরাহ বৃদ্ধি করা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উষ্ণতা, অনাবৃষ্টি ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টি, সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের ওপর ক্রমেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। নদীগুলোয় লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশের ফলে মিঠা পানির মাছ ও প্রাথমিক উৎপাদনশীলতায় পরিবর্তন ঘটছে। মাছের আবাসস্থল, বিচরণত্রে, অভিপ্রয়াণ ও প্রজনন প্রভাবিত হচ্ছে। জলবায়ুর ধারাবাহিক ক্রমাবনতির ফলে মাছের অনেক আচরণগত বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হচ্ছে। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মাছের প্রজাতি-বৈচিত্র্যেও। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাওয়ায় পুকুর-দিঘির পানির স্তর কমে যাচ্ছে। সারা বছর যেসব পুকুরে পানি থাকত, সেসব পুকুর মৌসুমি পুকুরে (শুধু বর্ষায় পানি থাকে) রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য আবাসস্থল, রাস্তাঘাট, বেড়িবাঁধ ও শিল্পকারখানা নির্মাণ, পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট করার ফলে আবাদি পুকুর ও প্রাকৃতিক জলাশয়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে মৎস্য উৎপাদন তথা দেশীয় মাছ উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে জমিতে অতিমাত্রায় বালাইনাশক প্রয়োগ, পোনা ও ডিমওয়ালা মাছ নিধন এবং মাছের প্রজনন মৌসুমে নির্বিচারে মাছ ধরার কারণে এখন আর পরিচিত অনেক দেশি মাছের সন্ধান মেলে না।
দেশের অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মোট ২৬১ প্রজাতির মিঠাপানির মাছ রয়েছে। ২০১৫ সালের আইইউসিএনের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। তবে দেশীয় এ মাছ যাতে মানুষের পাতে আবার ফিরিয়ে আনা যায় এবং বিলুপ্ত না হয়, সেজন্য সরকারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে লাইভ জিন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের অব্যাহত প্রচেষ্টায় প্রায় ৪০ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। যে অঞ্চলে এ মাছ বিলুপ্ত হবে, লাইভ জিন ব্যাংক থেকে সে অঞ্চলে মাছের পোনা সরবরাহ করা হবে, যাতে সে অঞ্চলে নতুন করে দেশীয় মাছের বিস্তার ঘটতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশি মাছে আছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন। তাছাড়া দেশি মাছের আছে অন্ধত্ব, রক্তশূন্যতা, গলগন্ড প্রতিরোধ ক্ষমতা। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ছোট ছোট মাছ খাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। দেশি মাছের এসব পুষ্টিগুণ আমিষের নিরাপত্তা গড়ে তুলতে অতুলনীয়। এ কারণেই দেশি মাছ সংরক্ষণ ও চাষ করা দরকার। অতিমূল্যবান এসব মাছ রক্ষা করতে হলে এগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের আওতায় আনতে হবে। বদ্ধ জলাশয়ে দেশি প্রজাতির মাছ যাতে বেশি পাওয়া যায়, সেজন্য বেশকিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। সেগুলো হলো-ধানখেতে ছোট প্রজাতির মাছ চাষের ব্যবস্থা করা এবং এ ধরনের মাছ সারা বছর পাওয়ার জন্য ধানখেতে মিনি পুকুর তৈরি; অপরিকল্পিত বালাইনাশক ব্যবহার না করা, মাছের প্রজনন মৌসুমে মাছ না ধরা, কারেন্ট জাল, চায়না দুয়ারি ও ফাঁস জাল ব্যবহার না করা, রাক্ষুসে মাছ কমানোর জন্য পুকুরে বা প্রাকৃতিক জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ না করা, রুইজাতীয় মাছের সঙ্গে ছোট প্রজাতির মাছের মিশ্র চাষ, জলাশয়, প্লাবনভূমি ও পুকুরে দেশি মাছের চাষাবাদের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে মৎস্যসম্পদের গুরুত্ব, মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, উন্মুক্ত, বদ্ধ ও সামুদ্রিক এলাকায় নিরাপদ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের ভূমিকা এবং মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে জনগণকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
মাছের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জীবন-জীবিকার ও বেঁচে থাকার। অতীতকাল থেকেই এ দেশ ছিল মাছের ভান্ডার। প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস হলো মাছ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত পুষ্টি চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হয় মাছ থেকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ঋঅঙ-এর প্রতিবেদন ‘ঞযব ঝঃধঃব ড়ভ ডড়ৎষফ ঋরংযবৎরবং ধহফ অয়ঁধপঁষঃঁৎব ২০২২’ অনুসারে, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে তৃতীয় এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ উৎপাদনে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ এবং এশিয়ায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ক্রাস্টাসিয়ান্স আহরণে বিশ্বে ৮ম এবং কোস্টাল ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম স্থান অর্জন করেছে। এছাড়া বিশ্বের ১১টি ইলিশ উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে রয়েছে। ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যায় এ মাছ।
বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। মৎস্য উৎপাদনে আমাদের সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও স্বীকৃতি অর্জন করেছে। দেশে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও মুক্ত জলাশয়ে এখনো বহু প্রজাতির মাছ বিদ্যমান এবং এসব মাছ যথামাত্রায় বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; যাতে করে মা মাছ সারা বছর প্রতিটি মৎস্য বিচরণ ক্ষেত্রের অভয়াশ্রমে অবস্থান করতে পারে। উল্লেখ্য, বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো, অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়কে বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে এসব জলাশয় থেকে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার হাওড়ের মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করছেন, যার ফলে মাছের উৎপাদন বাড়বে এবং গ্রামবাংলায় এ খাতে নিয়োজিত মানুষের আয়ও বাড়বে। সর্বোপরি দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ হবে। গড়ে ওঠবে মেধাবী জাতি। সমৃদ্ধ হবে গ্রামীণ অর্থনীতি। পূর্ণতা পাবে দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি।
লেখকঃ গণযোগাযোগ কর্মকর্তা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়